কলিকাতার আসিতেছিলেন। তৎকালে বীরসিংহ হইতে কলিকাতায় আসিবার পথ সুগম ছিল না। পিতামহীর সহিত আসিবার সময়ে তাহার কোন গ্রামের নিকটবর্ত্তী হইয়া শুনিলেন যে জনৈক গহস্থের গৃহ হইতে হৃদয়বিদারক ক্রন্দনধ্বনি উথিত হইতেছে। ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়া দয়া ও করুণার মূর্ত্তিমতী প্রতিকৃতি ভগবতী দেবী পৌত্র নারায়ণচন্দ্রকে বলিলেন, “দাঁড়াত; এ বাড়ীতে কেন কাঁদিতেছে একবার শুনিয়া আসি।” এই কথা বলিয়া ভগবতী দেবী বালক নারায়ণচন্দ্রকে তথায় সাবধানে থাকিতে বলিয়া সেই গহস্থের বাটীতে প্রবেশ করিলেন। বালক নারায়ণচন্দ্র কিয়ৎক্ষণ তাঁহার অপেক্ষায় সেই পথের ধারে বসিয়া রহিলেন। পিতামহীর বিলম্ব হইতেছে দেখিয়া কারণ জানিবার জন্য গৃহস্থের বাটীতে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, পিতামহী সেই অপরিচিত গৃহস্থের ক্রন্দনে যোগ দিয়াছেন। পৌত্র নারায়ণচন্দ্রকে যে দাঁড়াইয়া থাকিতে বলিয়া আসিয়াছেন, তাহাদের সহিত কাঁদিতে বসিয়া সে কথা ভুলিয়া গিয়াছেন। ধন্য বিশ্বপ্রেম! তুমিই মানুষকে আত্মহারা করিয়া পরসেবায় নিয়োজিত করিতে পার! তোমার অসীম প্রভাব!
এই প্রকার অপরিমেয় সেবাগুণেই তিনি বীরসিংহ ও তন্নিকটবর্ত্তী গ্রামসমূহের আপামর সাধারণকে মুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। তিনি পরের বিপদকে আপনারই বিপদ বলিয়া মনে করিতেন। কেহ বিপদাপন্ন হইয়াছে, ইহা তাঁহার শ্রুতিগোচর হইবামাত্রই তিনি তৎক্ষণাৎ সেইখানে উপস্থিত হইতেন এবং তাহার বিপন্মোচনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। রোগার্ত্তের পাশে উপবেশন করিয়া তিনি জননীর ন্যায় তাহার শুশ্রষা করিতেন। রোগীর মলমূত্র তিনি চন্দনবৎ জ্ঞান করিতেন। তিনি স্বহস্তে তাহা মুক্ত করিতেন, তাঁহার মনে কিছুমাত্র ঘৃণার উদ্রেক হইত না। রুগ্নের শুশ্রুষায় তাঁহার আত্মপর বা ইতরভদ্র ভেদ ছিল না। হাড়ি, ডোম, তেওর, বাগ্দী প্রভৃতি কিছুই বিচার ছিল না। কেহ পীড়িত হইয়াছে কর্ণগোচর হইলেই তাহার শয্যাপার্শ্বে তিনি সমাসীন হইতেন। তিনি কাহারও ঔষধের ব্যবস্থা করিতেছেন,কাহারও পথ্য রধন করিয়া দিতেছেন, কাহারও বা অন্যবিধ শুশ্রুষা করিতেছেন, এইরূপে রুগ্নের পার্শ্বে তিনি মাতৃমূর্ত্তিতে বিরাজমান থাকিয়া সতত তাহাদিগকে অভয় প্রদান করিতেন। কোন বালিকা বিধবা হইয়াছে বা কাহারও পুত্রবিয়োগ ঘটিয়াছে শ্রবণমাত্রই তিনি সেই শোকার্ত্ত পরিবারের মধ্যে উপস্থিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করিতে থাকিতেন। মধ্যে মধ্যে তিনি শোকে এতদূর অধীর হইয়া পড়িতেন যে, ধূলায় অবলুণ্ঠিত হইতে থাকিতেন। একসময় কোন প্রতিবেশীর একমাত্র পুত্র কঠিন পীড়াগ্রস্ত হয়। ভগবতী দেবী আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া সেই বালকের শুশ্রূষায় দিবারাত্রি অতিবাহিত করিতেন। এইরূপে একাদিক্রমে তিনি ১০।১২ দিন রাত্রি জাগরণ করিয়ছিলেন ইহাতে কিছুমাত্র তাহার ক্লেশানুভব হয় নাই।