পরিশেষে তাঁহার ক্রোড়েই সেই বালকের মত্যু হয়। তখন তিনি পুত্রশোকাতুরা মাতার ন্যায় সেই মৃতদেহ বক্ষে ধারণ করিয়া উম্মত্তের ন্যায় যেরূপ করুণ বিলাপ করিয়াছিলেন, তাহা শ্রবণ করিলে পাষাণ হৃদয়ও বিদীর্ণ হইয়া যায়। পুত্রশোকাতুরা জননীর নিকট হইতে সন্তানের মৃতদেহ গ্রহণ করা যেরুপ দুরূহ ব্যাপার, তাঁহার নিকট হইতে সেই বালকের মৃতদেহ গ্রহণ করা ততোধিক দুরূহ ব্যাপার হইয়াছিল। এরূপ দ্রবীণহৃদয়,—এরূপ সমবেদনা,—এরুপ লোকসেবা—প্রকৃতপক্ষেই ইহজগতে এক বিচিত্র ব্যাপার। জীবসেবাই যেন তিনি শিবসেবা মনে করিতেন। লোকসেবায় তাঁহার ভগবৎসেবায়ই যেন প্রতীতি জন্মিত। ধন্য ভগবতী দেবী। তোমার সমস্তই বিচিত্র লীলা!
পথিপার্শ্বে কোন জীবজন্তুর মতদেহ দেখিলে, অশ্রুধারায় ভগবতী দেবীর বক্ষঃস্থল প্লাবিত হইত। গৃহপালিত কোন জীবজন্তু যন্ত্রণায় কাতর হইয়া পড়িয়াছে দেখিতে পাইলেই তিনি তাহার শুশ্রূষায় নিরত হইতেন। তিনি যখন শেষবার কাশীযাত্রা করেন, তথায় এক অশীতিপর বৃদ্ধা পীড়িত হইয়াছেন এবং তাঁহার শুশ্রূষার কেহ নাই শ্রবণমাত্র ভগবতী দেবী তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহার সেবায় ব্যাপৃত হইলেন। তিনি স্বহস্তে ঐ বৃদ্ধার মলমূত্র পরিষ্কার করিতেছেন দেখিয়া বৃদ্ধা লজ্জিত হইতেছেন বুঝিতে পারিয়া ভগবতী দেবী বলিলেন, “আপনি লজ্জিত হইতেছেন কেন? আপনি আতুর, আপনার সেবা আর স্বয়ং অন্নপূর্ণার সেবায় প্রভেদ কি? ইহা ত মলমূত্র নহে, ইহা চন্দন! আমার মনে বিন্দুমাত্র ঘৃণার উদ্রেক হয় নাই।” বৃদ্ধা ভগবতী দেবীর এই কথা শ্রবণ করিয়া তাঁহার হৃদয়ের অন্তস্তলের আশীর্ব্বাদ তাঁহাকে জ্ঞাপন করিয়াছিলেন। পরে বৃদ্ধা সুস্থ হইলে, ভগবতী দেবী বিদ্যাসাগরকে বলিয়া তাঁহার ও অপর আরও দুই একটি বৃদ্ধার মাসহারার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন।
বধূ ও কন্যাগণ বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে, ভগবতী দেবী অধিকাংশ সময় লোকসেবায় অতিবাহিত করিতেন। তিনি দিবাভাগের সন্ধ্যা বন্দনাদি সমাপন ও কিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়া প্রতিদিন বীরসিংহ ও তন্নিকটবর্ত্তী পল্লীসমুহের গৃহে গৃহে ভ্রমণ করিতেন। কাহারও মুখ বিষন্ন দেখিলে, তাঁহার হৃদয় বিদীর্ণ হইত। অপাঙ্গ ভেদ করিয়া অশ্রুধারা নিপতিত হইত। তিনি তৎক্ষণাৎ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেন, “তোমার মুখ শুষ্ক কেন? তোমার কি খাওয়া হয় নাই? তোমার কি অর্থকষ্ট হইয়াছে?” এইরপে তিনি গৃহে গৃহে সকলের অভাব জানিয়া তাহার প্রতিবিধান করিতেন। ইহাই তাঁহার নিত্য নৈমিত্তিক কার্য্য ছিল।
ভগবতী দেবী শেষবার যখন কাশীধামে গমন করেন, তখন তাঁহার মাসাধিক তথায় অধিস্থতি করিবার ব্যবস্থা হয়। এই কথা শ্রবণ করিয়া বীরসিংহ ও তন্নিকটবর্ত্তী গ্রামের অধিবাসীবৃন্দ শোকাকুল হইয়াছিলেন। তিনি দুঃস্থ লোকদিগের মাসাধিকের জন্য সমস্ত দ্রব্যের ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তিনি