পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/১০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চরিত্রমাহাত্ম্য
৯৭

করিয়া, একপ্রাণ হইয়া, তিনি তাঁহার দয়াপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করতেন। তাঁহার, দয়া কখনও স্বার্থের পূতিগন্ধে বা পক্ষপাতদোষে অপবিত্র বা কলঙ্কিত হয় নাই। কিংবা দানে অহঙ্কার প্রকাশে তাঁহার আদৌ প্রবৃত্তি ছিল না। তিনি পরের উপকারের জন্যই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং পরের উপকার করিয়াই জীবৎকাল পর্য্যবসিত করিয়াছিলেন। তাঁহার চরিত্রের আর এক মাহাত্ম্য বিলাসিতার সহিত পরার্থ পরতার বিষম দ্বন্দ্ব। তিনি বিলাসিতারূপ ব্যাধিকে পরিবার মধ্যে প্রবেশ লাভ করিতে দেন নাই। এবং বিলাসিতার স্থলে মিতাচারের প্রয়োগ দ্বারা পরার্থ পরতা সাধন করিয়াছিলেন।

 তাঁহার চরিত্রের আর এক মাহাত্ম তিনি তাঁহার পূর্ব্বাপর অবস্থা স্মতিপথে জাগরূক রাখিতে পারিয়াছিলেন। তিনি বালিকা বধূ বেশেই শ্বশুর গহে আগমন করিয়াছিলেন এবং দরিদ্র সংসারেই প্রতিপালিত হইয়াছিলেন। কিন্তু সেই দরিদ্র অবস্থা তিনি চিরজীবন স্মৃতিপটে অঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উন্নতির সহিত ভাগ্যের যথেষ্ট পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছিল। কিন্তু সৌভাগ্যের পরাকাষ্ঠার সময়েও তাঁহার মানসিক অবস্থার পরিবর্ত্তন ঘটে নাই। তিনি দীনভাবে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং দীনভাবেই ইহসংসার পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। তাঁহার চরিত্রের আর এক মাহাত্ম্য-জীবনের দুর্দ্দিনে যাহা তাঁহার নিত্যসহচর ছিল, সুদিনেও তিনি তাহার নিত্য পূজা করিয়াছিলেন। চরকায় সূতা কাটিয়া সেই সূতা বিক্রয় দ্বারা তাঁহার শ্বশ্রূদেবী অতিকষ্টে সংসার যাত্রা নির্ব্বাহ করিতেন। আমরণ ভগবতী দেবী সেই চরকার নিত্যপূজা করিয়াছেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যখন একাদশ বৃহস্পতির অবস্থা, তখন পর্যন্তও রাত্রি দেড় ঘটিকার পর প্রায় দুই ঘণ্টা একাকিনী বসিয়া ভগবতী দেবী নিত্য চরকায় সূতা কাটিতেন। তাহাতে তিনি কিছু মাত্র অপমান বোধ করিতেন না। হারিসন্ সাহেব যখন বীরসিংহের বাটীতে আগমন করেন, তখন ঐ চরকা দেখিয়া সাহেব শম্ভুবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “এটা কি?” শম্ভুবাবু; তাহার কোন সদুত্তর না দিয়া বিষয়ান্তরে সাহেবের চিত্ত আকৃষ্ট করিয়াছিলেন। পরিশেষে সাহেব প্রস্থান করিলে, শম্ভবাবু ক্রোধপরবশ হইয়া সেই চরকা ভাঙ্গিয়া ফেলেন। ভগবতী দেবী তাঁহার এই ব্যবহারে এতদূর দুঃখিত হইয়াছিলেন যে, তিনি একদিন অন্নজল পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। পরিশেষে শম্ভবাবু চরকা নির্মাণ করিয়া দিলে, তিনি অন্নজল গ্রহণ করিয়াছিলেন। আমরা মহাত্মা রামদনলাল সরকারের চরিত্রেও এইরপে মাহাত্ম্য দেখিতে পাই। রামদোল হাটখোলা দত্তবাটীর সরকার ছিলেন। পরিশেষে তাঁহার সাধুতার পুরস্কার স্বরূপ মদনমোহন দত্ত তাহাকে লক্ষ টাকা প্রদান করেন। যখন রামদুলাল অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিপতি তখনও তিনি দত্তগৃহে মাসিক বেতন দশ টাকা স্বয়ং আনিতে যাইতেন। এবং মদনমোহন দত্তের সম্মুখে যাইবার সময় পাদুকা পরিত্যাগ করিয়া করযোড়ে তাঁহার সম্মখে দণ্ডায়মান থাকিতেন।