পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/১১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০০
ভগবতী দেবী

হইলেন। পরিশেষে রন্ধনাদি কার্য্য সমাপনান্তর সকলের পরিচর্য্যা করিয়া স্বয়ং ভোজন করিলেন। ভেজনান্তেই শয়ন করা তাহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল। কিয়ৎক্ষণ বসিয়া বিশ্রাম করিতেছেন এবং সকলের সহিত বিবিধ কথোপকথন করিতেছেন এমন সময়ে বিষম বিসূচিকা রোগে তিনি আক্রান্ত হইলেন। দীনবন্ধু দ্রুতপদে চিকিৎসকের নিকট গমন করিলেন। তিনি মুহূর্ত্ত মধ্যে চিকিৎসককে সঙ্গে লইয়া গৃহে প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। সকলেই প্রাণপণে শুশ্রষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু রোগ ক্রমেই ভীষণ মূর্ত্তি ধারণ করিতে লাগিল। ক্রমে আরও দুই একজন চিকিৎসক আসিলেন। নিশাশেষে চিকিৎসকের পরামর্শ করিয়া বলিলেন, “জীবনের আর কোন আশা নাই।”

 ক্রমে রজনী প্রভাতা হইল। পুনরায় কাশীধামের চতুর্দ্দিক বিবিধ বাদ্যধ্বনিতে মুখরিত ও স্পন্দিত হইতে লাগিল। পুনরায় হোমগন্ধে চতুর্দ্দিক আমোদিত হইয়া উঠিল। পুনরায় ‘হর', ‘হর’, ‘বম্’, ‘বম্’ ধ্বনিতে চতুর্দ্দিক বিকম্পিত হইল।—এ সমস্ত কি কাশীধামের বিশ্বেশ্বর ও মহামায়ার পূজার আয়োজন? না-সাধ্বী সতী ভগবতীর স্বর্গারোহণের আবাহন। সাধু পাঠকগণ! সাধ্বী পাঠিকাগণ! হদয় থাকে ত একবার উপলদ্ধি করুন—উপলব্ধি করিয়া নীরবে অশ্রুবিসর্জ্জন করুন। কারণ, সংসারে স্বর্গ, নরক বলিয়া কিছুই জানি না—এই মৃত্যুতেই স্বর্গ নরকের পরিচয়! পাপী, তাপী বলিয়া কিছুই জানি না, এই মত্যুতেই তাহার পরিচয়। সরল, কপটাচারী বলিয়া কিছুই জানি না, এই মত্যুতেই সে সকলের পরিচয়। সেইজন্য মৃত্যুই সাধুদিগের উপাস্য! তাঁহার প্রেমভরে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিয়া থাকেন! এই মত্যুই বিশুদ্ধ পবিত্র বহ্নি! -ইহাই মানবাত্মাকে বিশ্বের পরপারে লইয়া যাইবার সময় পরিশুদ্ধ করে!

 ক্রমে মৃত্যু সন্নিকট দেখিয়া সকলে ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। ভগবতী সকলকে ক্ষীণস্বরে সুমিষ্টবাক্যে সান্তনা করিয়া, পরিশেষে পতির পদধুলি চাহিলেন। শান্ত, দান্ত, ধৈর্য্যশীল ঠাকুরদাস এতক্ষণ পর্যন্ত স্থিরভাবে ছিলেন। কিন্তু এইবার তাঁহার ধৈর্য্যচুতি হইল। আর তিনি শোকাবেগ সংবরণ করিতে পারিলেন না। গণ্ডস্থল বহিয়া প্রবল বেগে অশ্রুধারা নিপতিত হইতে লাগিল। ক্রন্দন করিতে করিতে ঠাকুরদাস গদগদস্বরে বলিতে লাগিলেন, “তুমি সাধ্বী সতী! তোমাকে আমি আর কি আশীর্ব্বাদ করিব! তুমি নিজ পুণ্যবলে অগ্রেই গমন করিলে। তোমারই জয় হইল! তুমি যে সদা সর্ব্বদা বলিতে,‘জপ তপ কর, কিন্তু মরতে জান‍্লে হয়।—কিরূপ করিয়া মরিতে হয়, যথার্থই তাহা তুমিই জানিয়াছিলে। তোমার অক্ষয় স্বর্গলাভ হউক।”

 ক্রমে ভগবতী দেবীর সংজ্ঞালোপ হইল। পুত্রপ্রদত্ত জলবিন্দু; ওষ্ঠপ্রান্তে গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। নাভিদেশ ঘন ঘন স্পন্দিত হইতে লাগিল। সাধ্বী সতী যোগনিদ্রায় অভিভূত হইলেন!—মুখমণ্ডলে অপূর্ব্ব শান্তি! অপূর্ব্ব