জ্ঞান-জগতে খনা ও লীলাবতীর সদৃশী হন, যাহাতে তাঁহারা বুঝিতে পারেন যে, পুরুষের ন্যায় তাঁহাদেরও অধ্যাত্মবিদ্যায় অধিকার আছে, তাঁহারাও বেদের অর্থবোধ ও মন্ত্র দর্শনে সমর্থা এবং তাঁহারা সেই সচ্চিদানন্দময়ীর শক্তির বিকাশমাত্র,—এই দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় লাভ করিয়া নিজ নিজ চরিত্রবলে যাহাতে তাঁহারা তাঁহাদের সন্ততিগণের চরিত্রগঠনে সহায় হন, এরূপ ভাবে কোন অধীত বিদ্যা শিক্ষা দিবার প্রণালী তখন লোকচিন্তার অতীত ছিল। সুতরাং ভগবতী দেবীর ভাগ্যে বাল্যকালে এরূপ ভাবের কোন শিক্ষালাভ ঘটে নাই। কিন্তু তাঁহার মাতুলালয়ে আদর্শ হিন্দু পরিবারে প্রতিদিন যে ধর্মকর্ম্মের অনুষ্ঠান দেখিতেন, তাঁহার সম্মুখে যে জ্বলন্ত আদর্শ বিদ্যমান ছিল, তদ্দারা তাঁহার যে কোন শিক্ষালাভ হয় নাই, এ কথা আমরা স্বীকার করিতে পারি না। কারণ, ইন্দ্রিয়, মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের পূর্ণতা লাভই যথার্থ শিক্ষা; চক্ষুঃ কর্ণাদি ইন্দ্রিয়গণের উপযুক্ত ব্যবহার ও বিষয়পরিচালনাই যথার্থ শিক্ষা। ইন্দ্রিয়গণ যথাযথ সংযত হইলে, উহাদের দ্বারা সূক্ষ্ম বিষয়ের অনুভূতি হয়, মন ও বুদ্ধির স্ফুরণ হয় ও চিত্তের উদারতা সম্পাদিত হয়। মাতুলালয়ে আদর্শ হিন্দুপরিবারের মধ্যে লালিত পালিত হওয়ায়, কিরূপ করিয়া ধর্ম্মকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিতে হয়, লোকের কল্যাণচিন্তা করিতে হয়, কিরূপ করিয়া লোকের সহিত ব্যবহার করিতে হয়, কেমন করিয়া দেখিতে হয়, বলিতে হয়, চলিতে হয়, বসিতে হয় প্রভৃতি অশেষ কল্যাণকর অত্যাবশ্যক শিক্ষালাভ ভগবতী দেবীর বাল্যকালেই পূর্ণমাত্রায় হইয়াছিল। সুশীলতা, ভব্যতা, ঔদার্য্য, বিনয়, শিষ্টাচার ও সৌজন্য প্রতি সদ্গণ যে সামাজিক বন্ধনের প্রধান উপায়, এ শিক্ষার বীজ তাঁহার বাল্যহৃদয়েই অঙ্কুরিত হইয়াছিল।
আলস্য ও জড়তা তাঁহার দেহে কখনও স্থান পায় নাই। তিনি প্রত্যুষে শয্যা পরিত্যাগ করিয়া প্রাতঃকৃত্য সমাপন করতেন। পুষ্পচয়ন, পুষ্পপাত্রসম্মার্জ্জন, ও বিবিধ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহকর্ম্মে তিনি অনুক্ষণ লিপ্ত থাকিতেন। এ সম্বন্ধে কেহ কখন তাঁহাকে শ্রমবিমুখ হইতে দেখে নাই। তিনি শ্রমেই শান্তিলাভ করিতেন, এবং শ্রমেই বিশ্রামসুখ অনুভব করিতেন। আমরা এ স্থলে তাঁহার শৈশব-জীবনের দুই একটি ঘটনার উল্লেখ করিয়া এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি করিব।
মহাপুরুষ বা নারীরত্নরপে যাঁহারা জন্মপরিগ্রহ করেন, তাঁহাদিগের সহিত সাধারণ মনুষ্যের প্রভেদ এই দেখিতে পাই যে, তাঁহারা যাহা বলেন, তাহা করিতে পারেন ও করেন। তাঁহাদের উক্তিই তাঁহাদের যথার্থ জীবনী। সাধারণ মানুষ বহু শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করিয়া অনেক সারবান্ উপদেশ দিতে পারেন, কিন্তু সেগুলি স্বীয় জীবনে প্রতিফলিত করিতে পারেন না। মহাপুরুষ জগতের কল্যাণসাধনে সতত সচেষ্ট। তিনি মানবজাতির উন্নতির নূতন নূতন পথের আবিষ্কার করেন; সাধারণ মানবের ন্যায় তিনি সুখদুঃখ বা হাস্যক্রন্দনের মধ্য দিয়া স্বীয় বহুমূল্য জীবন অতিবাহিত করেন না। জীবনের প্রথম অংশেই আত্মীয়স্বজনের দুঃখ ও