পর, তাঁহার পুত্রগণের বিষয়বিভাগ উপলক্ষে পরস্পর বিষম মনান্তর ঘটে। রামজয় ধার্ম্মিক ও উদারস্বভাব ছিলেন। তিনি অকিঞ্চিৎকর বিষয়ের জন্য, প্রাণসম সোদরবর্গের সহিত বিরোধ করা অতি গর্হিত কর্ম্ম বিবেচনা করিয়া, দুইটি পুত্র ও চারিটি কন্যা রাখিয়া, কাহাকেও কোন কথা প্রকাশ না করিয়া, সন্ন্যাসীর বেশে তীর্থপর্য্যটনে প্রস্থান করেন। রামজয় তর্কভূষণ দেশত্যাগী হইলেন; তদীয় পত্নী দুর্গাদেবী পুত্রকন্যা লইয়া বনমালিপুরের বাটীতে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন! অল্পদিনের মধ্যেই দুর্গাদেবীর লাঞ্ছনাভোগ ও তদীয় পুত্রকন্যাদের উপর কর্ত্তৃপক্ষের অযত্ন ও অনাদর, এতদূর পর্য্যন্ত হইয়া উঠিল যে, দুর্গাদেবী পুত্রদ্বয় ও কন্যাচতুষ্টয়কে লইয়া, পিতৃভবন বীরসিংহে আগমন করিলেন। তাঁহার পিতা উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত, সমাদরপূর্বক নিরাশ্রয়া দুহিতা ও তাঁহার সন্তানগণকে স্বীয় সদনে আশ্রয় দিলেন। তৎকালে তাঁহার জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র ঠাকুরদাসের বয়ঃক্রম দশ বৎসর ও কনিষ্ঠ কালিদাসের প্রায় সাত বৎসর। তর্কসিদ্ধান্ত উভয় দৌহিত্রের লেখাপড়া শিক্ষার নিমিত্ত বীরসিংহনিবাসী গ্রহাচার্য্য পণ্ডিত কেনারাম বাচস্পতিকে নিযুক্ত করিলেন। আচার্য্য মহাশয় তৎকালে ঐ প্রদেশের মধ্যে জ্যোতিষ শাস্ত্রে অদ্বিতীয় পণ্ডিত ছিলেন। তিনি স্বল্প দিবসের মধ্যেই ভ্রাতৃদ্বয়কে বাঙ্গলা ভাষা, শুভঙ্করী অঙ্ক ও জমিদারী সেরেস্তার কাগজ প্রভৃতি শিক্ষা দিয়া পরে সংক্ষিপ্তসার ব্যাকরণ অধ্যয়ন করাইতে প্রবৃত্ত হইলেন। উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত অতিশয় বৃদ্ধ হইয়াছিলেন; এজন্য সংসারের কত্তৃত্ব তদীয় পুত্র রামসুন্দর ভট্টাচার্য্যের হস্তে ন্যস্ত ছিল। উক্ত রামসুন্দর ভট্টাচার্য্যের পত্নীর সহিত দুর্গাদেবীর মনোমালিন্য ঘটিল। দুর্গাদেবী পরিশেষে বৃদ্ধপিতা তর্কসিদ্ধান্তকে সবিশেষ অবগত করিলেন। তিনি বলিলেন, আমি সকলই বিশেষরূপ অবগত আছি। অতঃপর উহাদের সহিত তোমার একত্র সদ্ভাবে বাস করা চলিবে না। পৃথক্ স্থানে বাস করা নিতান্ত আবশ্যক। দুর্গাদেবী তাহাতে সম্মত হইলেন। পরদিন তর্কসিদ্ধান্ত গ্রামস্থ ভদ্রলোকদিগকে আহ্বান করিয়া বলিলেন যে, রামসুন্দরের ও বধূমাতার সহিত দুর্গার এক গৃহে বাস করা দুরূহ, অতএব আমি স্বতন্ত্র স্থানে ইহার গৃহ নির্ম্মাণ করিয়া দিব স্থির করিয়াছি। তাহাতে গ্রামস্থ ভদ্রলোকগণও সম্মত হইলেন। অনন্তর বার্ষিক নয় টাকা পাঁচ আনা জমায় কিঞ্চিৎ ভূমি লইয়া, তাহাতে গৃহ নির্ম্মাণ করিয়া দিলেন; পরে জমিদারকে বলিয়া ও অনুরোধ করিয়া উক্ত জমি লাখরাজ করিয়া দিবেন স্থির করেন। ইতিমধ্যে তর্কসিদ্ধান্ত ইহজগৎ পরিত্যাগ করিয়া লোকান্তর গমন করিলেন। সুতরাং এই নূতন বাস্তু আর লাখরাজ হইল না। এই বাস্তুর বার্ষিক কর জমিদরকে দিতে হইল। দুর্গাদেবীর সংসার নির্ব্বাহের উপায়ান্তর ছিল না। তৎকালে বিলাতী সার আমদানি হয় নাই; এ প্রদেশের নিরুপায় অনেক স্ত্রীলোকেই টেকুয়া ও চরকায় সূতা কাটিয়া, সেই সূতা বিক্রয় করিয়া অতিকষ্টে
পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/২০
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০
ভগবতী দেবী