বীরসিংহে গমন করিলেন। গৈরিকবসন পরিধান করিয়া, হিন্দুস্থানী সন্ন্যাসীর বেশে শ্বশুরবাটীতে সমুপস্থিত হইলেন। প্রথমতঃ কাহাকেও আত্মপরিচয় না দিয়া, গ্রামের মধ্যে ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার কনিষ্ঠা কন্যা অন্নপূর্ণা দেবী পিতাকে চিনিতে পারিয়া, ‘বাবা’ বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিয়া উঠিলেন। তখন রামজয় আত্মপরিচয় দিলেন। কয়েক দিবস বীরসিংহে অবস্থিতি করিয়া পরিবারবর্গকে বনমালিপুরে লইয়া যাইবার উদ্যোগ করিলেন। কিন্তু তাঁহার পত্নী বনমালিপুরে যাইতে সম্মত হইলেন না। যেহেতু তাঁহার ভ্রাতৃবর্গ অসদ্ব্যবহার করিয়াছেন; এতাবৎকালের মধ্যে তাঁহাদের কোন সংবাদ গ্রহণ করেন নাই; সুতরাং রামজয় অগত্যা বীরসিংহে পরিবারবর্গকে রাখিতে বাধ্য হইলেন।
রামজয় অতি বুদ্ধিমান্, বলশালী, সাহসী, তেজস্বী ও স্বাধীনচেতা পুরুষ ছিলেন। নীরবে কাহারও নিকটে কোন অবমাননা সহ্য করা তাঁহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল। চিরজীবন তিনি নিজ অভিপ্রায়ের অনুবর্ত্তী হইয়া চলিয়াছেন। কাহারও নিকট কোন উপকার প্রত্যাশায় হীনতা স্বীকার করা অপেক্ষা মৃত্যুই তিনি শ্রেয়ঃকল্প বলিয়া মনে করিতেন। তিনি অতিশয় অমায়িক ও সদাশয় লোক ছিলেন। সকলকে তিনি সমভাবে দেখিতেন এবং সকলের প্রতি সস্নেহ ব্যবহার করিতেন; এবিষয়ে তাঁহার উচ্চ নীচ প্রভেদজ্ঞান ছিল না। তিনি একাহারী, নিরামিষাশী ও নিষ্ঠাবান ও নৈমিত্তিক কর্ম্মে সবিশেষ অবহিত ছিলেন বলিয়া সকলে তাঁহার প্রতি যোগীর ন্যায় ভক্তি প্রকাশ করিত।
তিনি লৌহযষ্টি হস্তে লইয়া সর্ব্বত্র ভ্রমণ করিতেন, কাহাকেও ভয় করিতেন না। এক সময়ে বীরসিংহ হইতে মেদিনীপুর যাইতেছেন, পথিমধ্যে এক ভল্লুক দেখিতে পাইলেন। ভল্লুক দেখিয়া ভয় না পাইয়া এক বৃক্ষের অন্তরালে দণ্ডায়মান হইলে, ভল্লুক তাঁহাকে আক্রমণ করিবার জন্য বৃক্ষের চতুর্দ্দিকে তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ঘূর্ণমাণ হওয়ায় তিনিও অগ্রে অগ্রে ঘুরিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ভল্লুক দুই হস্ত প্রসারণপূর্ব্বক বৃক্ষটি বেষ্টন করিয়া তাঁহাকে ধরিবার চেষ্টা করিল; ঐ সময় রামজয় বৃক্ষের অপর পার্শ্ব হইতে ভল্লুকের দুই হস্ত ধরিয়া বৃক্ষে ঘর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তাহাতে ভল্ল্লুক মৃতপ্রায় হইলে, ছাড়িয়া দিলেন। ভল্লুক মৃতকল্প ভূপতিত দেখিয়া, তিনি প্রস্থান করিতে উদ্যোগী হইলেন। এমন সময়, ভল্লুক উঠিয়া দ্রুতবেগে দৌড়িয়া গিয়া রামজয়ের পষ্ঠে নখাঘাত করিল, তখন পৃষ্ঠে শোণিত ধারা বিগলিত দেখিয়া ক্রোধভরে লৌহদণ্ড প্রহারে তিনি ভল্লুকের প্রাণ বিনাশ করিলেন। ভল্লুকের পাঁচটি নখাঘাতের ক্ষতে প্রায় মাসাধিক কষ্ট পাইয়া পরে আরোগ্য লাভ করেন।
বীরসিংহের বাস্তুবাটীর ভূস্বামী, রামজয়কে নিষ্কর ব্রহ্মোত্তর করিয়া দিবেন মানস করিয়াছিলেন; কিন্তু রামজয় দান গ্রহণ করিতে সম্মত হন নাই। গ্রামের অনেকেই লাখরাজ করিবার জন্য তাঁহাকে অনেক উপদেশ দিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি