পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিবাহ ও বাল্যজীবন
১৫

ভোজ্যসামগ্রীর দান ও সাবধানে সমস্ত দ্রব্য রক্ষা করিতেন। তিরস্কার বাক্য মুখে আনিতেন না। গুরুজনের নিকটে উচ্চ আসনে উপবেশন বা উচ্চকথা কহিতেন না। সকলের প্রতি অনুকূলতা দেখাইতেন, আলস্যশূন্য হইয়া কালযাপন করিতেন, কখনও অতিহাস্য বা অপরিস্কৃত স্থানে বাস করিতেন না এবং কখনও ক্রোধের বশীভূত হইতেন না। শ্বশুর ও স্বজনের প্রতি ভক্তি দেখাইতেন, দেবর, ননন্দার প্রতি মায়া মমতা প্রদর্শন এবং পরিবারস্থ লোকদিগকে বিনয়নম্র ব্যবহারে পরিতুষ্ট করিতেন। তিনি অতি অল্প বয়সেই এই সমুদায় সুগৃহিণীর ধর্ম্ম অবগত হইয়াছিলেন। এক কথায় বলতে গেলে, তিনি সেই দুঃখদারিদ্র্যময় সংসারে দগ্ধ হৃদয়ের শান্তিদাত্রী, নিরাশয়ের আশাদায়িনী, বিপদে বন্ধু, কৌতুকে সখী, রন্ধনে পাচিকা, ভোজনে জননী, সেবায় পরিচারিকাস্বরূপা ছিলেন। পতিসেবায়, দয়া দাক্ষিণ্যে ও গুরুভক্তিতে তিনি এক আদর্শ হিন্দুরমণী ছিলেন।

 শুনিয়াছি, মহারাজ দুষ্মন্তের পত্নী শকুন্তলা পতিগৃহে গমন কালে মহর্ষি কন্ব তাঁহাকে উপদেশ দিয়াছিলেনঃ—

‘শুশ্রূষষ্ব গুরূন্ কুরুপ্রিয়সখীবৃত্তিং সপত্নীজনে
ভর্ত্তবিপ্রকৃতাপি রোষণতয়া মাস্ম প্রতীপং গমঃ।
ভুয়িষ্ঠং ভব দক্ষিণা পরিজনে ভোগেষ্বনুৎসেকিনী।
যান্ত্যেবং গৃহিণীপদং যুবতয়ো বামাঃ কুলস্যাধয়ঃ॥”

তুমি এস্থান হইতে পতিগৃহে গমন করিয়া শ্বশ্রূ প্রভৃতি গুরুজনকে সেবা করিবে, সপত্নীজনের প্রতি প্রিয়সখীর ন্যায় ব্যবহার করিবে, স্বামী অবমাননা করিলেও ক্রোধবশতঃ তাঁহার প্রতিকূলাচরণ করিও না। পরিজনের প্রতি অত্যন্ত অনুকূল হইবে। অভ্যুদয়ে অহঙ্কৃত হইও না। যুবতীগণ এইরপে গৃহণী পদ প্রাপ্ত হইয়া থাকে; প্রতিকূলচারিণীগণ গহের যন্ত্রণাস্বরূপ। জানি না, ভগবতী দেবীরও পতিগৃহে আগমন সময়ে, তাঁহার মাতুল মহাত্মা রাধামোহন বিদ্যাভূষণ মহাশয়, তাঁহাকে এরূপ কোন সরবান উপদেশ দিয়াছিলেন কি না!

 ভগবতী দেবীর বাল্যকালের সেবাধর্ম্ম, দীনতা, তেজস্বিতা প্রভৃতি সদগুণসমুহ যৌবনকালীন অপরাপর ইন্দ্রিয়গণের স্ফূর্ত্তি সঙ্গে সঙ্গে যেন নুতন মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিয়াছিল। সাংসারিক কোন বিষয়ের অস্বচ্ছলতা হইলে, তিনি প্রাণান্তেও প্রতিবেশীর দ্বারস্থ হইতেন না। তিনি যেন মনে করিতেন, হিতৈষিতা বা কল্যাণ, প্রকৃতির উদ্দেশ্য সত্য; কিন্তু যতবার উপকৃত হইব, ততবার উপকারীর নিকট আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতে হইবে এবং এই আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা চিরজীবন অক্ষুণ্ন রাখিতে হইবে। যিনি ভূয়িষ্ঠপরিমাণে অন্যের হিতসাধন করিতে পারেন, তিনিই যথার্থ গরীয়ান্। যে কখন অন্যের উপকার করে না, কেবল অপরের হিতাস্পদ হয়, তাহার ন্যায় নিকৃষ্টস্বভাব জঘন্যকর্ম্মা লোক আর জগতে নাই; অন্যের নিকট উপকার গ্রহণ করা, অথচ অন্যের উপকার না করাই