বিশ্বমধ্যে অতিহীন কর্ম্ম। উপকারীর প্রত্যুপকার করা প্রায় জগৎ মধ্যে ঘটিয়া উঠে না, কিন্তু উপকৃত হইলে, তৃতীয় জনের হিতসাধনার দ্বারা তাহা পূর্ণমাত্রায়, বিন্দু বিসর্গ পর্য্যন্ত পরিশোধ করতেই হইবে। জীবনের ঋণ মুক্তহস্তে পরিশোধ করিয়া যাওয়াই সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম।
কিন্তু প্রতিবেশীদিগের মধ্যে কেহ সদিচ্ছাপ্রণোদিত হইয়া কোন দ্রব্য দিলে, ভগবতী দেবী তাহা কখনও প্রত্যাখ্যান করিতেন না, দেবপ্রসাদ ভাবিয়া সাদরে গ্রহণ করিতেন। ফলতঃ তিনি প্রতিবেশীদিগের সহিত অচ্ছেদ্য প্রীতিবন্ধনে আবদ্ধ থাকিতে সতত যত্ন করিতেন। তাঁহার শ্বশ্রূদেবীর সহিত কাহারও কখন মনোমালিন্য ঘটিবার উপক্রম হইলে, তিনি তাঁহাকে অতি বিনীত ভাবে বলিতেন, “মা, প্রভাতে উঠিয়া যাহাদিগের মুখ দেখিতে হইবে বা যাহাদিগকে মুখ দেখাইতে হইবে, তাহাদিগের সামান্য ত্রুটি তুচ্ছজ্ঞান করিয়া তাহাদিগের সহিত সদ্ভাব রক্ষা করিতে যদি সতত আপনি যত্নবতী না হন, তাহা হইলে লোকে আপনার দেবীচরিত্রে নিশ্চয়ই দোষারোপ করিবে। আর মা, আপনি দিবারাত্রি আমাদের কত দৌরাত্ম্য সহ্য করিতেছেন, প্রতিবেশীদিগের একটি দৌরাত্ম্য কি আপনি সহ্য করিতে পারিবেন না?” দুর্গাদেবী বধমাতার মুখনিঃসৃত এই সকল অমৃতময় বাক্য শ্রবণ করিয়া কোন প্রতিবাদ করিতেন না। ঈষৎ হাস্য করিয়া হৃষ্টচিত্তে ভগবতী দেবীকে আশীর্ব্বাদ করিতেন।
পল্লীর সমবয়স্কা রমণীগণ তাঁহার সদ্ব্যবহারে ও স্নেহে এতদূর মুগ্ধ হইয়াছিলেন যে, প্রত্যেকে মনে করিতেন, তিনি প্রত্যেককেই অধিক ভালবাসেন। তিনি তাঁহাদের সুখদুঃখের সঙ্গিনী ছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে কেহ পীড়িত হইলে, তিনি অনন্যমনে তাঁহার শুশ্রূষা করিতেন। মধ্যে মধ্যে পথ্যাদি গৃহ হইতে রন্ধন করিয়া লইয়া যাইতেন। তাঁহার স্নেহ ও মমতার এমনই এক আকর্ষণী শক্তি ছিল যে, গহপালিত জীবজন্তু পর্যন্ত তাঁহাকে দেখিলে, আনন্দে অধীর হইয়া পড়িত, তিনি তাহাদের যথাবিধি সেবা করিয়া পরম সন্তোষ লাভ করিতেন। ফলতঃ কি মহাপুরুষ, কি মহতী নারী সকলেই আপনাকে তৃণ হইতেও লঘু মনে করেন।
“তৃণাদপি নীচেন তরোরপি সহিষ্ণুনা।
অমানিনা মানদেন কীর্ত্তনীয়ঃ সদা হরিঃ॥”
এই মহাবাক্য তাঁহাদের হৃদয়ের মূল মন্ত্র। আত্মাভিমান তাঁহাদের কিছুই থাকে না। তাঁহারা মনে করেন, এ বিশ্ব তাঁহাদের এবং তাঁহারা এ বিশ্বের; সুতরাং সমত প্রাণিজগৎ তাঁহাদের প্রেমের বিষয়ীভূত। সেই জন্য, ইহসংসারে তাঁহাদের দ্বেষ্য কেহই থাকে না, সকলেই প্রিয় হয়।
ভগবতী দেবী মনস্বিতা ও সাধুতা বিষয়ে একজন অগ্রগণ্য স্ত্রীলোক ছিলেন। রূপলাবণ্য এবং বিবিধ সদ্গুণে গৃহের শ্রীস্বরূপা ছিলেন, ফলতঃ তাঁহার চূর্ণকুন্তলের মুক্তকেশপাশ দেখিলে, স্নেহপাশ বলিয়াই মনে হইত। আকর্ণবিশ্রান্ত