নেত্রদ্বয় কারুণ্যপূর্ণ ছিল, মুখমণ্ডলে যেন তাঁহার বিশ্বব্যাপী হৃদয়ের বিশ্বপ্রেম ফুটিয়া উঠিয়াছিল, তাঁহার ওষ্ঠদ্বয় দেখিলে, সত্য ও অমৃতের উৎস বলিয়াই মনে হইত, তাঁহার বাহুদ্বয় যেন সদা সেবাব্রতনিরত বলিয়া মনে হইত, তাঁহার সরলতাময় সৌন্দর্য্যে তরলতার চিহমাত্রও ছিল না, মাতৃভাবে পূর্ণ ছিল। এক কথায় বলিতে গেলে, তাঁহাকে দেখিলে মনে হইত, যেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা স্বর্গ হইতে মর্ত্তে অবতীর্ণ হইয়াছেন, এবং তাঁহার চরণারবিন্দে মস্তক অবলুণ্ঠিত করিয়া তাঁহার পদধুলিই গ্রহণ করিতে ইচ্ছা হইত।
শাত্রে গৃহস্থাশ্রমের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপাদিত হইয়াছে। মনু বলেনঃ—
যথা বায়ুং সমাশ্রিত্য বর্ত্তন্তে সর্ব্বজন্তবঃ।
তথা গহস্থমাশ্রিতা বর্ত্তন্তে সর্ব্ব আশ্রমাঃ॥
যস্মাৎ ত্রয়োহপ্যাশ্রমিণোজ্ঞানেনাম্নেন চান্বহম্।
গৃহস্থেনৈব ধার্য্যন্তে তস্মাজ্জ্যেষ্ঠাশ্রমো গৃহী॥
যেমন প্রাণবায়ুকে আশ্রয় করিয়া সমুদায় প্রাণী জীবিত রহিয়াছে, সেইরূপ গহস্থকে আশ্রয় করিয়া অপরাপর আশ্রমবাসিগণ জীবন ধারণ করিতেছেন। ব্রহ্মচারী, বানপ্রস্থ ও ভিক্ষু—তিন আশ্রমীই প্রতিদিন গহস্থকর্ত্তৃক বেদার্থব্যাখ্যান ও অন্নদানাদি দ্বারা প্রতিপালিত হইতেছেন, এ কারণ গহাস্থাশ্রম—সকল আশ্রম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। রমণীগণ এই সর্ব্বাশ্রমশ্রেষ্ঠ গহস্থাশ্রমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। পরম কারুণিক পরমেশ্বর লজ্জা, বিনয়, নম্রতা ও সুশীলতা ইত্যাদি সদ্গুণে ভূষিত করিয়া ললনাগণকে সৃজন করিয়াছেন। তাঁহারা সমাজের লক্ষীস্বরূপা এবং দুঃখদারিদ্র্যপূর্ণ ও রোগশোকতাপময় সংসারে, সতত শান্তির অমৃতধারা বর্ষণ করিয়া থাকেন। শাস্ত্রকারেরা এ নিমিত্ত সুস্পষ্ট উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, “শ্রীতে ও স্ত্রীতে কোনও প্রভেদ নাই।” ফলতঃ রমণীগণ মুর্ত্তিমতী দেবীর ন্যায় ইহসংসারে স্বর্গীয় সুখ বিতরণ করেন। সংসার ক্ষেত্রে ভারতরমণী পতিসেবায়, পতিভক্তিতে, সন্তান প্রতিপালনে, দয়াদাক্ষিণ্যে, গুরুভক্তিতে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠা। হিন্দু সমাজের সহিত হিন্দুরমণী শিক্ষায়, দীক্ষায়, সুখে দুঃখে শিরায় শিরায় ওতপ্রোত ভাবে বিজড়িত। আতিথ্য, দেবসেবা, শ্রাদ্ধ, তর্পণ প্রভৃতি হিন্দু শাস্ত্রকথিত কর্ম্মকাণ্ডগুলির ন্যায়, রমণীরত্নের কীর্ত্তিকলাপও হিন্দুসমাজের অঙ্গীভূত।
হিন্দুশাস্ত্রে কথিত আছে, ধর্ম্মচর্য্যার জন্য ভার্য্যার প্রয়োজন। হিন্দু রমণীগণ স্বামীর সহিত সর্ব্বথা ধর্ম্মকার্য্যে লিপ্ত থাকেন। ধর্ম্মপরিণীতা বনিতা যজ্ঞস্থানে উপস্থিত না হইলে গহস্থের যজ্ঞসমাপ্তি হয় না। এইজন্য তাঁহারা সহধর্ম্মিণী নামে অভিহিত হইয়া থাকেন। সংসাররূপ মহাযজ্ঞ সুসম্পন্ন করিতে হইলে, রমণীগণের ন্যায় অধিষ্ঠাত্রী দেবীরই প্রয়োজন। রঘুকুলতিলক গুণাভিরাম রামচন্দ্র সীতারপিনী অধিষ্ঠাত্রী দেবীর পাতিব্রত্য গুণে, অরণ্যবাসেও স্বর্গসুখ উপভোগ করিয়াছিলেন। মহাবীর পাণ্ডুনন্দনগণ কৃষ্ণারূপিণী অধিষ্ঠাত্রী দেবীর