পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮
ভগবতী দেবী

সেবায় মুগ্ধ হইয়া ভীষণ বনবাসরূপ অসহ্য ক্লেশ অনায়াসে সহ্য করিয়াছিলেন। দরিদ্র ঠাকুরদাসও তাঁহার পর্ণকুটীরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী পণ্যশীলা ভগবতী দেবীর— সদনুষ্ঠান ও সদাচারে মুগ্ধ হইয়াছিলেন বলিয়াই, প্রবাসবাস ও দখদারিদ্র্যজনিত অশেষ ক্লেশ, ক্ষণেকের জন্যও তাঁহার মনে অশান্তি উৎপাদন করিতে পারে নাই। এবং সন্ন্যাসিশ্রেষ্ঠ ভিখারি দেবাদিদেব মহাদেব অন্নপূর্ণা দেবীর সাহায্যে যেরূপ তাঁহার চিরদারিদ্র্যপূর্ণ সংসারেও সুখ শান্তি স্থাপন করিয়া ধনাধিপতি কুবেরেরও পুজ্য হইয়াছিলেন, সেইরূপ দরিদ্র ঠাকুরদাসও তাঁহার সহধর্ম্মিণী পুণ্যবতী ভগবতী দেবীর লোকসেবা, ধর্ম্মানুষ্ঠান ও মায়া মমতার সাহায্যে, তাঁহার ধনী নির্ধন সমস্ত আত্মীয় স্বজনের ভক্তি ও সম্মান লাভ করিয়াছিলেন।

 ভগবতী দেবী অতিশয় বুদ্ধিমতী এবং মিতব্যয় ও মিতাচারে অভ্যস্ত ছিলেন বলিয়া তাঁহার শ্বশ্রূদেবী গৃহের আয় ব্যয় সম্বন্ধীয় সকল কার্য্য নির্ব্বাহের ভার তাঁহার উপরেই অর্পণ করিয়াছিলেন। তিনি এই দরিদ্র সংসারেও অতি যত্ন সহকারে ও পবিত্রভাবে নিত্য নৈমিত্তিক ধর্ম্মানুষ্ঠানসকল সুসম্পন্ন করিতেন। ফলতঃ ভগবতী দেবীর গুণেই ঠাকুরদাসের পর্ণকুটীর শান্তিপূর্ণ পুণ্যাশ্রমে পরিণত হইয়াছিল। সংসারের শ্রীবৃদ্ধি সাধনের জন্য ভগবতী দেবী দিবারাত্রি সমভাবে পরিশ্রম করিতেও ক্লান্তিবোধ করিতেন না। নিশীথে যখন গৃহের প্রায় সকলেই নিদ্রার সুকোমল ক্রোড়ে বিশ্রামসুখ উপভোগ করিতেন, তখনও তিনি জাগরিত থাকিয়া পরিবারস্থ সকলের পরিধেয় বস্ত্র প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত চরকায় সূতা কাটিতেন।

 ভগবান্ মনু তাঁহার ধর্ম্মশাস্ত্রে স্ত্রীজাতির প্রতি বিশেষ সমাদর প্রদর্শন করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ—

“যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।”

স্ত্রীগণ যেখানে সমাদৃত, সম্মানিত ও পূজাপ্রাপ্ত হন, সেখানে দেবতারাও সন্তুষ্ট হইয়া থাকেন। ভগবতী দেবীর বিবিধ সদ্‌গুণে মুগ্ধ হইয়া পরিবারস্থ সকলে সতত তাঁহার প্রতি পরম সমাদর ও যত্ন প্রদর্শন করিতেন। বোধ হয়, সেইজন্যই দেবাশীর্ব্বাদে, দিন দিন ঠাকুরদাসের দরিদ্র সংসারের শ্রীবৃদ্ধি হইতে লাগিল।

 পুরাকালে আর্য্যেরাও স্ত্রীজাতির সম্যক আদর ও গৌরব করিয়া গিয়াছেন। ধর্ম্মপত্র যুধিষ্ঠির আপনার কিঙ্করীকে ‘ভদ্রে’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন। পরষ্পরের প্রতি কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসার সময় অগ্রে স্ত্রীলোকের বিষয় জিজ্ঞাসিত হইত। ভরত বনবাসী রামচন্দ্রের নিকট উপস্থিত হইলে, রামচন্দ্র তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “তুমি স্ত্রীলোকের প্রতি সম্মান দেখাইয়া থাক ত?” ধৃতরাষ্ট্রও এইরূপ এক সময়ে যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “রাজ্যের দুঃখিনী অঙ্গনারা ত উত্তমরূপে রক্ষিত হইয়াছে? রাজবাটীর স্ত্রীলোকদিগের প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হয় ত?” যে ব্যক্তি স্ত্রীলোকদিগের দ্রব্য অপহরণ, কি বিবাহিতা বা অবিবাহিতা