পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শিশুচর্য্যা ও সন্তানশিক্ষা
২৭

আশ্রয় করিবে। সর্ব্বদুঃখহারী ভগবান, আমাদের মঙ্গল করিবেন, তুমি তাঁহার শরণ লও। এরূপ ক্ষমাশীলা পুণ্যবতী জননীর সন্তান বলিয়াই পঞ্চমবর্ষীয় শিশু ধ্রুবের হৃদয় পুণ্যের পবিত্র ও বিমল জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হইয়াছিল; ধ্রুব কঠোর তপঃপ্রভাবে, পদ্মপলাশলোচন হরির কৃপা লাভে সমর্থ হইয়াছিলেন।

 থিওডোর পার্কার স্বীয় জীবনচরিতে লিখিয়া গিয়াছেন যে, তিনি যখন পঞ্চমবর্ষীয় বালক, তখন একদিন তাঁহার পিতার সঙ্গে বাড়ীর বহির্ভাগে কিয়দ্দূরে গমন করিয়া গৃহে জননীর নিকটে একাকী প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছিলেন। পথে দেখিলেন, একটি কূর্ম্মশিশুকে অপর কতিপয় শিশু প্রহার করিবার চেষ্টা করিতেছে, তিনিও বালস্বভাববশতঃ প্রহার করিবার জন্য যষ্টি উত্তোলন করিলেন, কিন্তু কে যেন তাঁহাকে হঠাৎ নিষেধ করিল! তিনি মাতার নিকটে তৎক্ষণাৎ দৌড়িয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা! কূর্ম্মশিশুকে প্রহার করিতে উদ্যত হইলে, আমাকে কে নিষেধ করিল?” জননী তাঁহাকে ক্রোড়ে করিয়া মখচুম্বন করিলেন এবং বলিলেন, “বৎস, লোকে উহাকে বিবেক বলে, কিন্তু আমি বলি, উহা ঈশ্বরের বাণী। তিনি তোমাকে অসৎ কার্য্য হইতে নিরস্ত করিলেন। তুমি যদি এইরূপ সর্ব্বদা তাঁহার নিষেধাজ্ঞা প্রতিপালন করিয়া চল, তাহা হইলে সর্ব্বদা সৎপথে বিচরণ করিতে পারিবে।” পার্কার বলিয়াছেন, ঐ দিনের ঘটনাটি ও মাতার ঐ উপদেশবাক্যটি চিরকাল তাঁহার হৃদয়ে জাগরূক থাকিয়া, তাঁহাকে ধর্ম্মপথে বিচরণ করিতে উৎসাহিত করিয়াছিল।

 শতবর্ষাধিক অতীত হইল, কলিকাতার সুপ্রিম কোর্টে স্যার উইলিয়ম জোন্স নামক একজন বিচক্ষণ বিচারপতি ছিলেন। জোন্স যখন তিন বৎসরের শিশু তখন তাঁহার পিতৃবিয়োগ হয়। পিতার মৃত্যু হইলে, তাঁহার সুশিক্ষিতা মাতার উপরই তাঁহার শিক্ষার ভার ন্যস্ত হয়, তাঁহার জননী অসাধারণ বিদ্যাবতী রমণী ছিলেন। অতি শৈশবকাল হইতেই মাতার যত্নে পাঠের প্রতি জোন্সের রুচি জন্মিয়াছিল। তিনি যখন দুই তিন বৎসরের বালক, তখন কোন নূতন বিষয় দেখিয়া, তাহার বিবরণ জিজ্ঞাসা করিলেই, মাতা বলিতেন, “পড়, পড়িলেই জানিতে পারিবে।” জননীর মুখে এই কথা বারম্বার শ্রবণ করায়, শিশু জোন্সের বিদ্যাশিক্ষার প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ জন্মিয়াছিল। তাঁহার এই অনুরাগ পঠদ্দশাতেই বর্দ্ধিত হইয়াছিল। এই সময়েই তিনি বিদ্যালয়ের নির্দ্দিষ্ট পাঠ ব্যতীত অনেক বিষয় শিক্ষা করিতেন। পঠদ্দশাতেই তিনি গ্রীক ও লাটিন এবং স্বকীয় যত্নে ভিনদেশীয় চারি পাঁচটি ভাষা শিক্ষা করিয়াছিলেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত হইলে, কতিপয় বৎসর পর, সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করিবার বাসনা তাঁহার এত প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল যে, অবশেষে তিনি ভারতবর্ষের পূর্ব্বতন রাজধানী কলিকাতা নগরীতে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতির পদ গ্রহণ করিয়া, সে বাসনাও চরিতার্থ করিয়াছিলেন।