জননীর সাধুতা ও ধর্ম্মনিষ্ঠার কথা স্মরণ করিয়া সন্তান অধর্ম্ম পথ হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়াছে, অনুতাপের অশ্রু বিসর্জ্জন করিয়া, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিয়াছে, এরপ ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়। ভাগ্যবলে মণিকার ন্যায় ধর্ম্মপরায়ণা সুধীরা জননীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়াই, দুষ্ক্রিয়াসক্ত সেণ্ট অগাষ্টিনের স্বকীয় দুর্দ্দশার জন্য ঘোরতর আত্মগ্লানির উদয় হইয়াছিল। এবং অনুতপ্ত হৃদয়ে কাতরকণ্ঠে আপনার পাপ স্বীকারপূর্ব্বক জগদীশ্বরের করুণা ভিক্ষা করিতে করিতে উন্মত্তের ন্যায় বলিয়াছিলেন,—“হে পরমেশ্বর! আমি তোমার দাসীর পুত্র, তোমার বাঁদীর সন্তান, তোমার চিরানুগত পরিচারিকার ধন।”
সন্তানের উপর মাতার প্রভাব যে অতি গুরুতর এবং মাতার ধর্ম্মশীলতা, আত্মসংযম ও সহিষ্ণুতা প্রভৃতি সদ্গুণের উপর যে সন্তানের ও সমাজের ভাবী শুভাশুভ সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে, তদ্বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নাই।
ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট স্বীয় জননীর আদেশ ভিন্ন অপর কাহারও আদেশ মান্য করিয়া চলিতেন না। তাঁহার যে মাতা সদপায় অবলম্বনপূর্ব্বক স্নেহ ও ভালবাসাপূর্ণ শাসন ও ন্যায়ানুষ্ঠান দ্বারা সন্তানকে তাঁহার প্রতি অনুরক্ত ও ভক্তিপ্রবণ হইতে এবং তাঁহার আদেশ প্রতিপালন করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন, সেই আদর্শ-রমণী জননীর নিকটই শৈশবকালে তিনি বাধ্যতাগুণ শিক্ষা করিয়াছিলেন। শৈশবের আশ্রয়স্থল জননীক্রোড়েই তিনি ধর্ম্মে বীর, নীতিতে অটল, অধ্যবসায়ে সুদৃঢ় ও উৎসাহে জ্বলন্ত বহ্নিশিখাবৎ গঠিত হইয়াছিলেন।
আমেরিকার ভূতপূর্ব্ব অস্থায়ী প্রেসিডেণ্ট এডাম বলেন, “শৈশবে আমি মানবজীবনের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সুখের নিদান সুশিক্ষিতা ও সম্পূর্ণরূপে সন্তানপালনে সমর্থা জননী লাভ করিয়াছিলাম। এবং তাঁহার নিকট যে ধর্ম্ম ও নীতিশিক্ষা করিয়াছিলাম, তাহা আমার চিরজীবন সঙ্গী হইয়া রহিয়াছে।”
শিশু বিদ্যাসাগর সকলের চক্ষের অগোচরে, জননীর স্নেহময় বক্ষে, শুক্লপক্ষের শশিকলার ন্যায় অনুদিন বর্দ্ধিত হইতে লাগিলেন। তাঁহার ভাগ্যে এডামের ন্যায় বিদ্যাবতী জননীলাভ ঘটে নাই। কারণ, বহু শতাব্দী ধরিয়া ভারতে স্ত্রীজাতি অজ্ঞানান্ধকারে আচ্ছন্ন ছিলেন। দেশে স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন ছিল না। কুমারসম্ভব ও বিক্রমোর্ব্বশী নাটক প্রভৃতি গ্রন্থে এই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, পুরাকালে স্ত্রীলোকেরা ভূর্জ্জপত্রে লিখতেন। তাঁহারা নানা বিষয় শিক্ষা পাইতেন। সংস্কৃত দশকুমারচরিত নামক গ্রন্থেও দেখিতে পাওয়া যায় যে, স্ত্রীলোকেরা বিদেশী ভাষা, চিত্রবিদ্যা, পুষ্পবিদ্যা, নৃত্যবিদ্যা, সঙ্গীত, তর্কবিদ্যা, গণনা, বাক্যবিন্যাস, সৌগন্ধ ও মিষ্টান্ন প্রস্তুতকরণ বিদ্যা, জীবিকানির্ব্বাহক অর্থকরী প্রমুখ বিদ্যা শিক্ষা করিতেন। কিন্তু হায়! যে ভারতবর্ষে স্ত্রীশিক্ষার আলোচনা এক সময়ে প্রকৃষ্টরূপে প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল; যে ভারতে দেবযানী, লোপামুদ্রা, বিশ্ববারা, রোমশা, ও বাক্ প্রভৃতি বিদুষী বনিতারা বেদমন্ত্র রচনা করিয়াছিলেন; যে ভারতে,