ভাস্করাচার্য্যের কন্যা লীলাবতী জ্যোতিষ শাস্ত্রে পারদর্শিনী হইয়া স্বনামে জ্যোতিষ গ্রন্থ প্রচার করিয়া জগতের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করিয়াছেন; যে ভারতে অনসূয়া, অরুন্ধতী, সাবিত্রী, মৈত্রেয়ী, শৈব্যা, গার্গী প্রভৃতি প্রাতঃস্মরণীয় রমণীগণ সাংসারিক সুখসম্ভোগ পরিহারপূর্ব্বক ধর্ম্মালোচনায় প্রবৃত্ত থাকিতেন; যে ভারতে, এমন দিন ছিল, যখন বারাণসী নগরীতে চতুম্পাঠী স্থাপন করিয়া হট্টি বিদ্যালঙ্কার নামে এক বিখ্যাত রমণী, ছাত্রদিগকে ন্যায় ও স্মৃতিশাস্ত্র পর্য্যন্ত শিক্ষা দিতেন; যে ভারতে, মিহিরের স্ত্রী খনা, জ্যোতির্বিদ্যা ও তাহার রচনার জন্য বিখ্যাত আছেন; যে ভারতে, চিতোরের রাণী মীরাবাই, আপন কবিত্বশক্তিগুণে জয়দেবের ন্যায় সুমিষ্ট কবিতা লিখিয়া গিয়াছেন; যে ভারতে, পৃথ্বীরাজ-লক্ষ্মী পদ্মাবতী, চৌষট্টি শিল্প ও চতুর্দ্দশ বিদ্যা জানিতেন; যে ভারতে, মালাবারে আভীর নামে একটি অবিবাহিত বিদ্যাবতী স্ত্রীলোক নীতি, কাব্য ও দর্শনবিষয়ক পুস্তকসকল রচনা করিয়া পাঠশালার পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে প্রচলিত করিয়াছিলেন; যে ভারতে, নানা শ্রেণীস্থ স্ত্রীলোকেরাও নানাপ্রকার বিদ্যাশিক্ষা করিতেন, দুর্ভাগ্যক্রমে সেই ভারতে শিক্ষা একবারে বিলুপ্ত হইয়া যায়। ক্রমে এদেশের লোকের এতাদৃশ কুসংস্কার জন্মে যে, নারীজাতি বিদ্যাশিক্ষা করিলে, তাহাদের বৈধব্য দশা ঘটিবে। ফলতঃ এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকেরা তৎকালে এবম্বিধ অকিঞ্চিৎকর ও অমূলক ভয়ে বিদ্যাভ্যাসে অনুরক্ত হইতেন না। দেশে যখন স্ত্রীশিক্ষার পথ এইরূপ ভাবে নিরুদ্ধ, তখন স্ত্রীলোকগণ গহপালিত পশুবৎ জীবন যাপন করিতেন, এরূপ যেন কেহ মনে না করেন। চরিত্রগত এবং অনুষ্ঠানগত শিক্ষাই দেশকে সজীব রাখিয়াছিল। তখন দেশে শাস্ত্রকথা, কথকতা, রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক উপাখ্যানসমূহ আদর্শ হিন্দুগৃহে প্রতিদিন ধ্বনিত হইত এবং এই সকল ধর্ম্মানুষ্ঠানই দেশের ধর্ম্মভাব ও নৈতিকভাব জাগরিত রাখিয়াছিল।
তখনকার জননীগণ রত্নাকরের মুক্তি, হরিশ্চন্দ্রের স্বার্থত্যাগ, যুধিষ্ঠিরের ন্যায়নিষ্ঠা, ভীষ্মের শরশয্যাতে শয়ন, অর্জ্জুনের রণকৌশল ও বাহুবল, রামচন্দ্রের পিতৃভক্তি, ভ্রাতৃবৎসলতা. লোকরঞ্জনের জন্য স্বার্থত্যাগ, লক্ষণের অগ্রজানুরাগ, সতী সাবিত্রীর পতিভক্তি প্রভৃতি উপাখ্যানগুলি সন্তানশিক্ষার প্রকৃষ্ট উপাদান বলিয়া মনে করিতেন। তখনকার সন্তানগণ মাতা, মাতামহী পিতামহী প্রভৃতির মুখের অন্নে অভ্যাগতের পরিচর্য্যা, অপরিচিত রুগ্নব্যক্তির সেবা শুশ্রূষা, বিপন্নকে আশ্রয়দান, ক্ষুধাতুরকে অনুদান করতে দেখিয়া পরোপকার ও সেবাধর্ম্ম শিক্ষা করিত। গ্রামের সামান্য লোকদিগের সহিতও ধনশালী সভ্রান্ত পরিবারের অল্পবয়স্ক বালকদিগেরও এক একটি সম্বন্ধ থাকিত, কেহ কাহাকে ঘৃণার চক্ষে দেখিত না। এইরূপে তাহারা দয়াশীল, হৃদয়বান ও মিষ্টভাষী হইতে শিক্ষা পাইত। পূর্ব্বে আদর্শপরিবারে বার মাসে তের পার্ব্বণ ছিল, ধর্ম্মানুষ্ঠান ছিল, গৃহের সর্ব্ববিধ কর্ম্মের মধ্য দিয়া সন্তানগণ শিক্ষা লাভ করিত। দেশে এই সকল