পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৪
ভগবতী দেবী

করিতেছিলেন। ক্রীড়াশেষে দেখিতে পাইলেন, একজন সঙ্গী ছিন্নবস্ত্র পরিধান করিয়া রহিয়াছে। তিনি তাহাকে আপনার বস্ত্রখানি গ্রহণ করিতে বলিয়া স্বয়ং তাহার ছিন্নবস্ত্রখানি পরিধান করিলেন। গৃহে সমাগত হইলে, মাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার বস্ত্র কোথায়? বালক উত্তরে সত্য ব্যাপার প্রকাশ করিলেন। মাতা সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, এই ত ভাল ছেলের কাজ; আমি চরকায় সুতা কাটিয়া তোমায় আর একখানি নতুন কাপড় প্রস্তুত করাইয়া দিব। সন্তানগণের এইরূপ সদনুষ্ঠান বা পরোপকারপ্রবৃৃত্তি দেখিলে, তাহাদিগের প্রতি আদর ও সস্নেহ ভাব প্রদর্শন করা তিনি অবশ্য-কর্ত্তব্য বলিয়া মনে করিতেন। কেবল তাহাই নহে, সেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি লক্ষ্য রাখিতেন যে, বালক বালিকার জীবনে তিনি যে সকল সৎপ্রবৃত্তি পরিকস্ফুুট দেখিতে ইচ্ছা করেন, তাহা ধীরে ধীরে তাহাদের হদয়ে বিকাশপ্রাপ্ত হইতেছে কি না।

 স্নেহ ভালবাসা বজ্জিত কঠোর শাসন যে কোমলমতি শিশুর পক্ষে অতীব অনিষ্টকর, তাহা তিনি বিলক্ষণ বুঝিতেন। কঠোর শাসনে শিশু; দিনদিন উৎসাহ ও স্ফুর্ত্তিহীন হইয়া পড়ে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে আলস্য, ভীরুতা ও শঠতা আসিয়া শিশুকে আশ্রয় করে। ভীরুতায় মনুষ্যত্বের লোপ পায়, এ সত্য বৃদ্ধ, যুবক, শিশু; সকলের পক্ষেই সমান। প্রয়োজন হইলে, শিশুকে প্রাণের স্নেহ মমতা দ্বারা পরিচালিত হইয়া শাসন করা উচিত। কোন কোন মাতা এরূপ আছেন যে, সন্তানের সামান্য অপরাধে উপেক্ষা প্রদর্শন করেন, ইহা অতীব অন্যায়। প্রদীপে একবার হাত দিয়া যন্ত্রণা অনুভব করিলে, শিশু; আর কখনও প্রদীপে হাত দিতে যাইবে না। এরূপ স্থলে, মাতার গুরতর শাসনের প্রয়োজন হয় না। কোন সন্তানের অসাবধানতা বশতঃ তাহার হস্তপদ ভগ্ন হইয়াছে, এরূপ স্থলে মাতার অগ্রে সন্তানের জীবন রক্ষার উপায় বিধান করাই সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। কিন্তু এরূপ অনেক নির্ম্মম মাতা আছেন যে, তাঁহার সেই সময়ে ক্রোধপরবশ হইয়া সন্তানকে ভয়ানক তিরস্কার করিতে আরম্ভ করেন। উপস্থিত কর্ত্তব্যের বিষয় একেবারে বিস্মৃত হইয়া যান। ভগবতী দেবীর প্রকৃতি এরূপ ছিল না। বালক বিদ্যাসাগর এক সময়ে ধানক্ষেত্রের নিকট দিয়া গমনকালে, ধানের শীষ তুলিয়া চিবাইতে চিবাইতে গমন করেন। শেষে ধান্যের শীষের শুঁয়া গলায় আটকাইয়া প্রাণসংশয় হইয়া উঠে। তদবস্থায় বাটীতে নীত হইলে, তাঁহার পিতামহী অতি কষ্টে সেই শুঁয়া বাহির করিয়া দেন, এবং সে যাত্রায় বিদ্যাসাগরের প্রাণরক্ষা হয়। মাতা সেই সংকটাপন্ন অবস্থায়, যাহাতে সন্তান বিপন্মুক্ত হয়, প্রথমতঃ তাহারই সহায়তা সর্ব্বতোভাবে করিয়া শেষে শিক্ষা দিলেন,—"বাবা, অমুক অমুক শস্যের শীষে শুঁঁয়া আছে, আর কখন এই সকল শস্যের শিষ চিবাইও না।”

 তিনি লোকের আত্মবিশ্বাসের উপর কখন কোন প্রকার আঘাত করতেন না। তিনি যেন এই আত্মবিশ্বাসের মধ্যে অমিত শক্তি, অমিত বল, কত প্রাণ, কত বীর্য্য,