পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৬
ভগবতী দেবী

 বিদ্যাসাগর বাল্যকালে অতিশয় অনাশ্রব (একগুঁয়ে) ছিলেন। এজন্য পিতা ঠাকুরদাস তাঁহাকে প্রহার পর্যন্ত করিতেন, এবং তাহার নাম রাখিয়াছিলেন-‘ঘাড় কেঁদো'। কিন্তু ভগবতী দেবী হৃদয়ের স্নেহ মমতার দ্বারাই তাঁহাকে সংযত করিতে চেষ্টা করিতেন। তিনি যেন জানিতেন, প্রগাঢ় সন্তানবাৎসল্যই শিশুকে আপনার হইতে আপনার করিয়া দেয়। তখন এমন কোন কার্য্যই নাই, যাহা তাহার দ্বারা করাইয়া লওয়া যায় না। শিশু যেমন ভালবাসার অধীন, এমন আর কেহই নহে। স্নেহ, মমতা ও বাৎসল্যের শাসনই প্রকৃত শাসন। ভগবতী দেবী বলিতেন, “সন্তান বালকবুদ্ধিবশতঃ কোন অন্যায় কার্য্য করিলে পর, মাতা যদি মুখ আঁধার করিয়া তাহার সহিত কিছুক্ষণ আলাপ বন্ধ রাখেন, আর সন্তান মাতাকে প্রসন্ন করিবার জন্য তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিয়া না বেড়ায়, তাহা হইলে, সে মাতাই বা কিরপ, তাঁহার ভালবাসাই বা কিরূপ, আর তাঁহার মায়ামমতাই বা কিরূপ, কিছুই ত বুঝিতে পারিলাম না।” ভগবতী দেবীর এই উক্তি হইতেই পাঠকগণ তাহার সন্তানবাৎসল্যের প্রগাঢ়তা অনুভব করিবেন।

 সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ তাঁহার চরিত্রের আর এক বিশেষ লক্ষণ ছিল। সহানুভূতিই সর্ব্ববিধ উন্নতির নিত্য সহচর এবং দায়িত্বজ্ঞানই মানুষকে সর্বোচ্চ উন্নতিসোপানে উন্নীত করিতে পারে, ইহাই যেন তাঁহার ধারণা ছিল। তিনি সন্তানগণকে বলিতেন, “আপনি ভাল কাপড় পরার চেয়ে, পরকে পরাইতে পারিলে, অধিক সুখ হয়। নিজে ভাল খাওয়া অপেক্ষা পরকে ভাল খাওয়াইতে পারিলে, অধিক আনন্দ হয়।” এইরূপে তিনি সন্তানগণের হৃদয়ে মনুষ্য জীবনের উচ্চতর ও গভীরতর দায়িত্বসকল অনুভব করাইয়া দিতেন।

 স্বীকার করি মানবের সদগুণাবলী স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সদগুণাবলীর বিকাশ শিক্ষাসাপেক্ষ। শিক্ষারূপ ইন্ধন না পাইলে, জ্ঞান ও বিদ্যাগ্নি প্রজ্বলিত হয় না। ক্রিয়ার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ভিন্ন, অন্য উপায়ে মানুষ মানুষকে শিক্ষা দিতে অসমর্থ। যদি কেহ সম্পূর্ণরূপে আপনাকে বিকাশ করতে সমর্থ হন, তবেই তাঁহার শিক্ষা দিবারও ক্ষমতা জন্মে। কিন্তু বিশুদ্ধ বাক্যপ্রয়োগ দ্বারা শিক্ষাদানে কেহ কখনই কৃতকার্য্য হন না। যিনি গ্রহণ করিতে সমর্থ, তিনিই কেবল শিক্ষা দিতে পারদর্শী, এবং গ্রহণ করিবার শক্তি না থাকিলে, কেহই শিক্ষিত হইতেও পারে না। ছাত্র-শিক্ষকের মনোভাব এবং বুদ্ধিবিশ্বাসের সমতলবর্ত্তী না হইলে, শিক্ষার আদান প্রদান কোন মতে সম্ভাবিত নহে। কারণ, শিক্ষাকালে পরস্পরের চিত্তসংযোগ বা বিমিশ্রণ ঘটিয়া থাকে। এইরপ চিত্তসন্নিপাতের সংঘটন হইলেই, কেবল প্রকৃত শিক্ষা কার্য্যোপযোগিনী হয় এবং প্রতিকূল দৈবপাত বা অসৎসংসর্গ হেতু তাহার উপকারিতা কোন কালেই সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় না। ভগবতী দেবীর এই সকল শিক্ষাদীক্ষা সকল সন্তানগণই সমান পরিমাণে লাভ করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার উপদেশের সফল আমরা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনেই যে অধিক