গুরুমহাশয়গণ বর্তমান স্কুলসমূহের শিক্ষকগণের ন্যায় কোনও কমিটি বা কোনও ব্যক্তির নিকট নির্দিষ্ট বেতন পাইতেন না। প্রত্যেক গৃহস্থ আপন আপন বালকদিগকে পাঠশালে দিবার সময় গরমহাশয়ের সহিত তন্ত্র ব্যবস্থা করিতেন। এইরুপে মাসে মাসে তাহার সামান্য ১০।১২ টাকা আয় হইত। তৎপরে যাত্রা, মহোৎসব, পার্বণ, বা পারিবারিক অনুষ্ঠানাদিতে উপরি কিছু কিছু জুটিত, তাহাতেই গুরুমহাশয়দিগের সংসারযাত্রা নির্বাহ হইত। পাঠে অমনোযোগী ও দুর্বৃত্ত ছাত্রগণ হাতছড়ি, লাড়ুগোপাল, ত্রিভঙ্গ প্রভৃতি বিবিধ দণ্ডে দণ্ডিত হইত। ১৮৩৪ সালে লর্ড উইলিয়ম বেণ্টিঙ্ক, মিষ্টর উইলিয়ম এডামকে দেশীয় শিক্ষার অবস্থা পরিদর্শনার্থ নিয়োগ করিয়াছিলেন। তিনি পাঠশালাসকলের অবস্থা পরিদর্শন করিয়া গবর্ণমেণ্টের নিকট একটি মন্তব্য প্রেরণ করেন। তাহাতে প্রায় চতুর্দ্দশ প্রকার দণ্ডবিধান প্রণালীর উল্লেখ দেখা যায়। তাহার অনেকগুলির বিবরণ শুনিলে হৃৎকম্প উপস্থিত হয়।
পঞ্চম বৎসর বয়সের সময় বিদ্যাসাগরের বিদ্যারম্ভ হয়। তৎকালে বীরসিংহ গ্রামে সনাতন বিশ্বাস পাঠশালার সরকার ছিলেন। সনাতন ছোট ছোট বালকগণকে শিক্ষা দিবার সময় বিলক্ষণ প্রহার করিতেন, তজ্জন্য শিশুগণ সদা শঙ্কিত হইয়া পাঠশালায় যাইতে ইচ্ছা করিত না। একারণ ঠাকুরদাস বীরসিংহ নিবাসী কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে শিক্ষক মনোনীত করিলেন। কালীকান্ত ভঙ্গ কুলীন ছিলেন, সুতরাং বহুবিবাহ করিতে আলস্য করেন নাই। তিনি ভদ্রেশ্বরের নিকট গোরুটি গ্রামেই প্রায় অবস্থিতি করিতেন। অপরাপর শ্বশর ভবনেও টাকা আদায় করিবার জন্য মধ্যে মধ্যে পরিভ্রমণ করিতেন। ঠাকুরদাস তাঁহাকে অনেক উপদেশ দিয়া, সমভিব্যাহারে করিয়া বীরসিংহে আনিলেন এবং কয়েক দিন পরে পাঠশালা স্থাপন করিয়া দিলেন। কালীকান্ত অত্যন্ত ভদ্রলোক ছিলেন। শিশুগণকে শিক্ষা দিবার বিশেষরুপ প্রণালী জানিতেন এবং তাহাদিগকে অতিরিক্ত যত্ন ও স্নেহ করিতেন। ছোট ছোট বালকগণ তাঁহার নিকট সর্ব্বদা অবস্থিতি করিতে ইচ্ছা করিত। এতভিন্ন তিনি সকলের সহিত সৌজন্য প্রকাশ করিতেন।স্থানীয় লোকগণ কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে আন্তরিক ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিত, এবং সকলেই তাঁহাকে গুরুমহাশয় বলিত। কালীকান্তের নিকট বিদ্যাসাগর কিঞ্চিদুন তিন বৎসর ক্রমাগত শিক্ষা করিয়া বাঙ্গালা ভাষা ও সামান্য অঙ্ক কসিতে শিখিলেন।ঐ সময়েই তাহার হস্তাক্ষর উৎকৃষ্ট হইয়াছিল। কালীকান্ত নানাপ্রকার কৌশল ও স্নেহ প্রদর্শন করিয়া শিক্ষা দিতে কিছুমাত্র এটি করেন নাই। তিনি আপন সন্তান অপেক্ষাও বিদ্যাসাগরকে ভালবাসিতেন। গুরুমহাশয় অপরাহ্নে অপরপর ছাত্রগণকে অবকাশ দিতেন। কেবল বিদ্যাসাগর মহাশয়কে তাঁহার নিকটে রাখিয়া সন্ধ্যার পর নামতা ও ধারাপাতাদি শিক্ষা দিতেন। অধিক রাত্রি হইলে, প্রত্যহ স্বয়ং ক্রোড়ে করিয়া বাটীতে আনিয়া বিদ্যাসাগরের পিতামহীর নিকট পৌঁছিয়া