ভাবিয়া অস্থির হইয়া পড়িলেন এবং আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিলেন। কলিকাতায় আসিবার জন্য ব্যগ্রতা প্রকাশ করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাঁহার স্বশ্রু দুর্গা দেবী পৌত্রের এই নিদারুণ পীড়ার সংবাদ শ্রবণ করিয়া অনতিবিলম্বেই কলিকাতায় উপস্থিত হইলেন এবং তথা হইতে পৌত্রকে দেশে লইয়া গেলেন।
তৎকালে পল্লীগ্রাম হইতে যে সকল লোক প্রথমে কলিকাতায় আসিতেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই অজীর্ণ রোগে আক্রান্ত হইতেন। এ পীড়াকে সাধারণতঃ সকলে ‘লোনা লাগা’ কহিত।
এখন পল্লীগ্রাম হইতে পীড়িত হইয়া লোকে সুস্থ হইবার জন্য কলিকাতা নগরীতে আগমন করে। তখন কলিকাতাতে দুই মাস অবস্থিতি করিলেই, লোকের শরীর ভগ্ন হইত এবং কলিকাতা হইতে বাহির হইলে, তৎপর দিনই শরীর একটু সুস্থ বোধ হইত। সে সময়ে কলিকাতার যে অবস্থা ছিল, তাহাতে এরুপ ঘটনা কিছুই বিচিত্র নহে। তখন জলের কল ছিল না। প্রত্যেক ভবনে এক একটি কূপ ও প্রত্যেক পল্লীতে দুই চারটি পুষ্করিণী ছিল। এই সকল পচা দুর্গন্ধময় জলপূর্ণ পুষ্করিণীগুলি জ্বরের উৎস স্বরপ ছিল। এতদ্ভিন্ন গবর্ণমেণ্ট স্থানে স্থানে কয়েকটি দীর্ঘিকা খনন করাইয়া দিয়াছিলেন, তাহাতে কাহাকেও স্নান করিতে দিতেন না। সেইগলি লোকের পানার্থ ব্যবহৃত হইত। তন্মধ্যে লালদিঘী সর্বপ্রধান ছিল। উড়িয়া ভারিগণ ঐ জল বহন করিয়া গৃহে গৃহে দিয়া আসিত। যখন জলের এই প্রকার দুরবস্থা, তখন অপর দিকে সহরের বহিরাকৃতিও অতীব ভীষণ ছিল। এখনকার ফুটপাথের পরিবর্তে প্রত্যেক রাজপথের পাশে জল নিগমের জন্য এক একটি বিস্তীর্ণ পয়ঃপ্রণালী ছিল। কোন কোনও পয়ঃপ্রণালীর পরিসর অট দশ হস্তেরও অধিক ছিল। প্রতি গৃহেই পথের পার্শ্বে এক একটি শৌচাগার ছিল। সেগুলি দিবারাত্রি অনাবৃত থাকিত। সেই জন্য নাসারন্ধ্র উত্তমরপে বস্ত্রাবৃত না করিয়া সেই সকল পথ দিয়া গমন করা দুরূহ ছিল। মাছি ও মশার উপদ্রব যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। সেই জন্যই বালক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলিয়াছিলেন,
“রেতে মশা দিনে মাছি,
দুই নিয়ে কলকেতায় আছি।”
বীরীসংহে ৩।৪ মাস অবস্থিতি করিয়া বিদ্যাসাগর রোগমুক্ত হইলেন। পুনর্বার জ্যৈষ্ঠ মাসে ঠাকুরদাস দেশে আসিয়া বিদ্যাসাগরকে সমভিব্যাহারে লইয়া কলিকাতায় যাত্রা করিলেন। ঐ সময়ে বিদ্যাসাগরকে ঠাকুরদাস জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন ঈশ্বর! এবার বরাবর বাটী হইতে কলিকাতায় চলিয়া যাইতে পারিবে ত? যদি চলিতে না পার, তাহা হইলে একজন লোক সঙ্গে লইব। সে মধ্যে মধ্যে তোমাকে ক্রোড়ে করিবে।” ভগবতী দেবী ও দুর্গাদেবীও বারম্বার অনুরোধ করিতে লাগিলেন কিন্তু বিদ্যাসাগর উত্তর করিলেন যে, ‘এবার চলিয়া যাইতে পারিব;