পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিদ্যাসাগরের বিদ্যাশিক্ষা
৪৫

পরিতৃপ্ত করিয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে তাঁহার আত্মজীবনচরিতে তিনি যাহা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তাহা উদ্ধৃত করিয়া পাঠকবর্গকে উপহার দিলামঃ—

 তাঁহার একমাত্র পুত্র গোপালচন্দ্র ঘোষ আমার প্রায় সমবয়স্ক ছিলেন। পুত্রের উপর জননীর যেরূপ স্নেহ ও যত্ন থাকা উচিত ও আবশ্যক ছিল, তাহাতে সংশয় নাই। কিন্তু আমার আন্তরিক দৃঢ় বিশ্বাস এই, স্নেহ ও যত্ন বিষয়ে আমার ও গোপালে রাইমণির অণুমাত্র বিভিন্নতা ছিল না। ফল কথা এই, স্নেহ, দয়া, সৌজন্য, অমায়িকতা, সদ্বিবেচনা প্রভৃতি সদগুণ বিষয়ে রাইমণির সমকক্ষ স্ত্রীলোক এ পর্য্যন্ত আমার নয়নগোচর হয় নাই। এই দয়াশীলা সৌম্যমূর্ত্তি আমার হৃদয় মন্দিরে দেবীমূর্ত্তির ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হইয়া বিরাজমান রহিয়াছে। প্রসঙ্গক্রমে তাঁহার কথা উপস্থিত হইলে, তদীয় অপ্রতিম গুণের কীর্ত্তন করিতে করিতে অশ্রুপাত না করিয়া থাকিতে পারি না। আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া অনেকে নির্দ্দেশ করিয়া থাকে। আমার বোধ হয় সে নির্দ্দেশ অসঙ্গত নহে। যে ব্যক্তি রাইমণির সেই দয়া, সৌজন্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করিয়াছে, এবং ঐ সমস্ত গুণের ফলভোগী হইয়াছে, সে যদি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী না হয়, তাহা হইলে তাহার তুল্য কৃতঘ্ন পামর ভূমণ্ডলে নাই।” শুনা যায়, মহাত্মা ডিঙ্কওয়াটার বেথুনও বাল্যকালে নারীজাতির স্নেহ, মমতা লাভ করিয়াছিলেন বলিয়া উত্তরকালে নারীজাতির বিশেষ পক্ষপাতী হইয়াছিলেন।

 বিদ্যাসাগর কলিকাতায় আগমন করিলে, প্রথমতঃ পুত্রবৎসলা জননী ভগবতী দেবী পুত্রের জন্য ব্যাকুল হৃদয়ে দিনযাপন করিতেন। এবং অবিরত অশ্রুবিসর্জ্জন করিয়া হৃদয়ের গুরুভার লাঘব করিতেন। পরিশেষে যেদিন শুনিলেন, রাইমণির দয়াদাক্ষিণ্যে প্রবাসে পরিপুষ্ট হইতেছেন, সেই দিন হইতে তিনি কথঞ্চিৎ ধৈর্য্যাবলম্বন করিতে পারিয়াছিলেন। সেইদিন হইতেই গৃহের অন্যান্য নিত্য নৈমিত্তিক ধর্ম্মানুষ্ঠানের ন্যায়, রাইমণির ও তাঁহার পুত্রের মঙ্গল কামনা তাঁহার নিত্য কার্য্যের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছিল।

 ইংরাজী ১৮২৯ সালের জুন মাসের প্রথম দিবসেই ঠাকুরদাস বিদ্যাসাগরকে কলিকাতাস্থ পটোলডাঙ্গা গবর্ণমেণ্ট সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের ৩য় শ্রেণীতে প্রবিষ্ট করাইয়া দিলেন। এই দিন বঙ্গসাহিত্যের ও বাঙ্গালা ইতিহাসের এক স্মরণীয় দিন। এই দিনের মাহাত্ম্য এক্ষণে আমরা সম্পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিতেছি। যে সুললিত দেবভাষা সংস্কৃতের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এ পর্য্যন্ত কেহই সাহসী হন নাই এবং যাঁহারা প্রতিযোগিতা করিবার উদ্যোগ করিয়াছিলেন, তাঁহারাও ব্যর্থমনোরথ হইয়াছেন, বাঙ্গালীর গৌরবের বিষয় বলিতে হইবে যে, আজ বঙ্গসাহিত্য এবং বঙ্গভাষা সেই সুললিত দেবভাষা সংস্কৃতের প্রতিদ্বন্দ্বিরূপে দণ্ডায়মান হইতে সাহসী হইয়াছে। বাঙ্গালীর সৌভাগ্য যে, বিদ্যাসাগর বঙ্গভাষার জননী সংস্কৃত-