পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৬
ভগবতী দেবী

ভাষার সেবার নিমিত্ত সংস্কৃত কলেজে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন। তাঁহার ন্যায় বিরাট মহাপুরুষ ব্যতীত কে মাতৃভাষার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিতে পারিতেন? তিনি সযত্নে ও পরিশ্রমে যে মাতৃভাষাতরু রোপণ করিয়া গিয়াছিলেন, তাহাতে অক্ষয়কুমার, বঙ্কিমচন্দ্র, কালীপ্রসন্ন, মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র প্রভৃতি বঙ্গজননীর কৃতী সন্তানগণ যত্নসহকারে প্রতিভাবারি সিঞ্চন করিয়াছেন বলিয়াই আজ আমরা মাতৃভাষাতরুকে ফুলপুষ্পে সুশোভিত মহীরুহরূপে অনুধ্যান করিতে পারিতেছি।

 বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কলেজে পরিগৃহীত হন, তখন তাঁহার বয়ঃক্রম নয় বৎসর মাত্র। ইহার পূর্ব্বে তাঁহার সংস্কৃত শিক্ষা আরম্ভ হয় নাই। আমার অপেক্ষা ক্লাসে আর কেহ উৎকৃষ্ট শিক্ষা করিতে না পারে, এরূপ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া বিদ্যাভ্যাস করিতে ঈশ্বরচন্দ্র চিরকাল আন্তরিক যত্ন পাইয়াছিলেন। এমন কি শৈশবকালে প্রায় সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া পাঠাভ্যাস করিতেন। প্রায়ই পিতাকে বলিতেন, ‘রাত্রি দশটার সময় আহার করিয়া শয়ন করিব, আপনি রাত্রি ১২টা বাজিলে আমায় তুলিয়া দিবেন, নচেৎ আমার পাঠাভ্যাস হইবে না।” পিতা আহারের পর দুই ঘণ্টা বসিয়া থাকিতেন। নিকটে আরমাণি গির্জার ঘণ্টারব শুনিয়া, তাঁহার নিদ্রা ভঙ্গ করিয়া দিতেন। পরে তিনি উঠিয়া সমস্ত রাত্রি অধ্যয়ন করিতেন। এইরূপ অত্যধিক পরিশ্রম করিয়া মধ্যে মধ্যে তিনি অত্যন্ত কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হইতেন। যেমন তিনি পাঠে অনুরক্ত ছিলেন, সেইরূপ শিক্ষকগণের প্রতি ভক্তিমান্‌ ও সমপাঠীদিগের সহিত প্রীতির বন্ধনেও আবদ্ধ ছিলেন। লোকে মনে করিয়া থাকে, লিখিয়া পড়িয়া কৃতী ও কার্য্যক্ষম হওয়ার নামই শিক্ষা। কিন্তু গুরু শিষ্যের ভক্তির সম্বন্ধ, বালকে বালকে সখ্যভাব যে শিক্ষার এক প্রধান অঙ্গ—তাহা অনেকে জানেন না। সেইজন্য বর্ত্তমান শিক্ষাপ্রণালীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ন্যায় মানুষ প্রস্তুত হওয়া একপ্রকার অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে।

 নয় বৎসর বয়সের সময় সংস্কৃত কলেজে প্রবিষ্ট হইয়া ২২ বৎসরের মধ্যে বিদ্যাসাগর কলেজের পাঠ্য সমস্ত বিদ্যায় পারদর্শী হইলেন। এই সময়ের মধ্যে তাঁহার অনুজ দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন ও শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং বিদ্যাসাগর ও দীনবন্ধু ন্যায়রত্নের শুভ বিবাহকার্য্য সুসম্পন্ন হইয়াছিল। সন্তানগণের পঠদ্দশায় ভগবতী দেবী চরকায় সুতা কাটিয়া পুত্রগণের জন্য বস্ত্র প্রস্তুত করিয়া কলিকাতায় পাঠাইয়া দিতেন। ভ্রাতৃগণ সেই মোটা বস্ত্র পরিধান করিয়া অধ্যয়নার্থ পটোলডাঙ্গায় কলেজে গমন করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আজীবন মোটা বস্ত্র পরিধান করিতে দেখা গিয়াছে। তিনি কখন সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধান করেন নাই।