পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৮
ভগবতী দেবী

অধিবাসিবৃন্দকে এক পরিবারস্থ মনে করিয়া, তাঁহাদেরই পরিচর্য্যায় আত্মসমর্পণ করিয়াছেন। কিন্তু জগতে সেরূপ রমণীরত্ন, ব্য সেরূপ মহাপুরুষ অতি দুর্লভ সে বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নাই।

 পারিবারিক বন্ধন মনুষ্যহৃদয়ে সুখ, শান্তি ও পবিত্রতা বিস্তার করে। লঘু ভেদে পরিবারস্থ পরস্পরের প্রতি পরস্পরের প্রীতি ও পরিচর্য্যার বিনিময়ই ইহার কারণ। জনক জননী যদি নিঃস্বার্থ প্রীতিবশতঃ সন্তানের হিতকামনা না করিতেন, সন্তান যদি স্বাভাবিক ভক্তিবশে পিতামাতার সেবা না করিত, পতি যদি প্রণয়ের অনুরোধে পত্নীর সুখ সাধনে যত্নবান্ না হইতেন, এবং পত্নী যদি পৃথিবীর সমস্ত আকর্যণ তুচ্ছজ্ঞান করিয়া সর্ব্বকালে সব স্থানে পতির সুখ দুঃখের অংশভাগিনী না হইতেন, তাহা হইলে এই সংসার মরীচিকাসঙঙ্কুল মরুভূমি বা ভয়ঙ্কর শ্মশানভূমি হইতেও যে ভীষণতর হইত, তাহা কে না স্বীকার করিবেন? সুখদঃখের অংশভাগী কাহাকেও যদি মানুয ইহসংসারে না পায়, তাহা হইলে সে জীবিত থাকিতে পারে না। কেহ কোন বিষয়ে অকৃতকার্য্য হইলে, তাহার সহিত সমবেদনা প্রকাশ করিবার অথবা তাহার দুঃখ উপশম করিবার জন্য ইহসংসারে যদি তাহার কেহ না থাকে, তাহা হইলে তাহার হৃদয় যে দুঃখভারে অবনত ও হইয়া পড়িবে, ইহা ধ্রুব নিশ্চিত। সেইরপ কোন ব্যক্তি অসাধ্যসাধনে কৃতকার্য্য হইয়া গৃহে প্রত্যাগত হইলে, যদি তাহার মুখের দিকে প্রসন্নভাবে দৃষ্টিপাত করিবার তাহার কেহ না থাকে, তাহার উৎসাহ ও তৃপ্তির অংশভাগী হয়, এরূপ কোন প্রিয়জন সে ইহসংসারে অন্বেষণ করিয়া না পায়, তাহা হইলে সৎকার্ষ্য ও সাধনায় তাহার অনুরাগ কোন ক্রমেই অনুদিন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতে পারে না।

 ইহসংসারে নারীপ্রকৃতি ও পুরুষপ্রকৃতি করুণাময় পরমেশ্বরেব দুই বিচিত্র সৃষ্টি। এই উভয় প্রকৃতিই অনুপম সৌন্দর্য্যের আধার। পুরুষের শরীর বলিষ্ঠ, কর্ম্মঠ, —নারীদেহ সুকোমল ও লাবণ্যে পরিপূর্ণ; পুরষপ্রকৃতি শৌর্য্য, বীর্য্য, দৃঢ়তা প্রভৃতি গুণের আধার—আর নারীপ্রকৃতি স্নেহ, মমতা, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি গুণের মূর্ত্তিমতী প্রতিকৃতি। বিধাতার এমনই সৃষ্টিকৌশল যে, পাছে, ঐ প্রকৃতিদ্বয় পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়া তাঁহার শুভ অভিপ্রায়ের পরিপন্থীরূপে যাবতীয় সৃষ্টিক্রিয়ার ব্যাঘাত উৎপাদন করে, এইজন্য তিনি উহাদিগকে পরম্পরসাপেক্ষ করিয়া দিয়াছেন। যেরূপ পর্ব্বতগাত্র নিঃসৃত দুইটি জলস্রোত সমতল ভূমিতে আসিয়া পরস্পর মিলিত হইযা এক হইয়া যায় এবং সেই একীভূত জলস্রোত শক্তি ও সৌন্দর্য্য বিস্তার করিতে করিতে অনন্ত সাগরাভিমুখে প্রধাবিত হয়, সেইরূপ রমণী ও পুরষ ইহসংসারে জন্মগ্রহণ করিয়া লালিত পালিত ও সম্বর্দ্ধিত হয়, এবং শুভ-পরিণয় যোগে পরস্পর সম্বন্ধ হইয়া অনন্ত উন্নতি ও সাধনার দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। ইহারই নাম স্বাভাবিক প্রেম। এই স্বাভাবিক প্রেমমুগ্ধ দুই অভিন্ন হৃদয়ের যে পরপর উদ্বাহ বন্ধন, তাহাই প্রকৃত পবিত্র