পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৪
ভগবতী দেবী

দেখিবার জন্য তিনি দুই এক ঘণ্টা অপেক্ষা করিতেন। ইহার মধ্যে কোন অতিথি উপস্থিত হইলে, মুখের অন্নে অভ্যাগতের পরিচর্য্যা করিতেন। শেষে হয়ত স্বয়ং উপবাস কিম্বা সামান্য জলযোগ করিয়া সমস্ত দিন যাপন করিতেন। তিনি যে কেবল আপনার সংসার লইয়াই দিবারাত্রি ব্যস্ত থাকিতেন এরূপ নহে। প্রতিবেশী দিগের মধ্যে কেহ হয়ত পীড়িত হইয়াছে, পথ্যাদি রন্ধন করিয়া দিবার লোক নাই, এই সকল তাঁহার কর্ণগোচর হইলেই তিনি তৎক্ষণাৎ নিজ গৃহ হইতে পথ্যাদি রন্ধন করিয়া প্রসন্নচিত্তে তাহাকে দিয়া আসিতেন। নিরন্তর তিনি কোন না কোন কার্য্যে ব্যাপত থাকিতেন। দ্বিপ্রহর রজনীতে ভোজনান্তে যখন সকলে বিশ্রাম সুখ লাভ করিত, তখনও তিনি একাকিনী বসিয়া চরকায় সুতা কাটিতেন। এইরূপে সংসারকে তিনি এক প্রকৃত কর্ম্মক্ষেত্রে পরিণত করিয়াছিলেন এবং হিংসা, দ্বেষ, অসূয়া প্রভৃতি মানসিক ব্যাধিসমূহ যাহাতে পরিবারস্থ জনগণকে আক্রমণ করিতে না পারে, তিনি তাহার প্রকৃষ্ট উপায় বিধান করিয়া রাখিয়াছিলেন। পরনিন্দায়, পরচর্চ্চায় তিনি অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ করিতেন। তিনি বলতেন, “তুমি নিজের মন্দ না করিয়া কখন পরের অপকার করিতে পার না। অপরকে লঘু; মনে করিতে গিয়া নিজেই লঘু হইয়া যাইবে। অপরের সহৃদয়তা গ্রহণ করিতে বিমুখ হইলে, তুমিও শীঘ্র হৃদয়শূন্য হইবে। তুমি স্বয়ং ভিন্ন অন্য কে তোমার অপকার করিতে পারে? তোমার যাহা অমঙ্গল ঘটে, তুমি নিজে তাহা দিবারাত্রি সঙ্গে সঙ্গে বহন করিয়া থাক; এবং নিজের দোষ ব্যতীত কখনই সত্য সত্য ক্লেশভোগী হও না। সুতরাং অপরের যাহা গুণ তাহাই দেখিবে ও আলোচনা করিবে। দোষের দিকে লক্ষ্য রাখিবে না। অন্যের প্রতি হিংসা, দ্বেষ প্রকাশ করিবে না। অন্যের ভাল দেখিলে আনন্দ প্রকাশ করিবে।”

 ফলতঃ সমাজে থাকিয়া ন্যায় ও প্রীতির বন্ধন ছেদন করিতে গেলেই শীঘ্র শাস্তিভোগ করিতে হয়। ভয় ও আশঙ্কা নানাদিকে উদিত হইয়া তাহার শাস্তি বিধান করে। যতদিন সহচর মানবগণের সহিত স্বভাবের সরল বন্ধনে আবদ্ধ থাকি, ততদিন তাহাদিগকে দেখিয়া কোন বিরক্তি জন্মে না। তখন পরস্পর মিলনে সরিৎ সঙ্গম বা দুই বায়ু প্রবাহের ন্যায় মিশিয়া এক হইয়া যাই। কিন্তু ঋজুপথ পরিত্যাগ করিয়া কুটিল পথ অবলম্বন করিলে, অথবা ‘আমার ভাল, তাহার নয়’ ইত্যাকার স্বার্থানুকূল কর্ম্মের চেষ্টা করিবামাত্র প্রতিবেশী অন্যায় বুঝিতে পারে। আমি তাহার প্রতি যতদূর সঙ্কোচ প্রকাশ করিয়াছি, সেও আমার প্রতি ততদূর সঙ্কোচ প্রকাশ করে। তাহার চক্ষু আর আমার চক্ষুকে অন্বেষণ করে না। বিরোধ উভয়ের অন্তরে উদিত হয় এবং তাঁহার মনে ঘৃণা ও আমার মনে ভয়ের সঞ্চার হইতে থাকে। সুতরাং আমার কার্য্যের জন্য আমিই একমাত্র দায়ী। ক্রিয়া মাত্রেরই দণ্ড ও পুরস্কার স্বতঃই বিহিত হইয়া থাকে। দণ্ড অপরাধের স্বভাবসহর। অপরাধ ও দণ্ড এক বৃক্ষ হইতেই সম্পন্ন। দণ্ডরূপ ফল, প্রমো