পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পারিবারিক জীবন
৫৫

কুসুমের স্নিগ্ধ ও সুরভি অভ্যন্তরেই অজ্ঞাতসারে পরিপক্কতা লাভ করে। ও পরিণাম, উপায় ও উদ্দেশ্য, বীজ ও ফল স্বভাবতঃ যুগ্ম সামগ্রী; তাহাদিগকে বিচ্ছিন্ন করা মনুষ্যের সাধ্য নহে। কারণ পরিণাম হেতুর অভ্যন্তরেই প্রস্ফুটিত ও উদ্দেশ্য উপায় মধ্যেই প্রাগ্বর্ত্তমান এবং বীজের অভ্যন্তরেই ফল স্বভাবতঃ সন্নিহিত।

 শ্বশ্রু দুর্গাদেবী যতদিন পর্য্যন্ত জীবিত ছিলেন, ততদিন ভগবতী দেবী সাংসারিক অনেক বিষয়ে তাঁহার পরামর্শ গ্রহণ করিতেন। এক সময়ে দুর্গাদেবী ভগবতী দেবীকে বলিয়াছিলেন, ‘মা, এখন সন্তানের মা হইয়াছ, গৃহিণী হইয়াছ, এখনও কি সমস্ত বিষয়ে আমার পরামর্শ লইয়া কাম করিতে হইবে?” তদুত্তরে ভগবতী দেবী বিনীত ভাবে বলিলেন, ‘মা বাপের নিকট সন্তান চিরকালই শিক্ষা করিবে। বাল্যকালেই মাতুলালয় হইতে এখানে আসিয়াছি। আপনিই লালন পালন করিয়াছেন, নানা বিষয়ে শিক্ষা দিয়াছেন। সংসারে আমার মা বলিতে আপনি ভিন্ন আর কেহই নাই। সাংসারিক বিষয়ে আমার অপেক্ষা আপনার জ্ঞান অনেক অধিক। যতদিন পর্য্যন্ত জীবিত থাকিবেন, ততদিন সকল বিষয়ে আপনার পরামর্শ লইয়াই কার্য্য করিব।” এই কথা শ্রবণ করিয়া দুর্গাদেবী আনন্দাশ্রু, বিসর্জ্জন করিতে করিতে পুত্রবধুকে আশীর্ব্বাদ করিলেন। ভগবতী দেবী দুর্গাদেবীকে মাতৃবৎ শ্রদ্ধা ও ভক্তি করিতেন, দুর্গাদেবী পরলোক গমন করিলে, ভগবতী দেবী এরূপ শোকাকুল হইয়াছিলেন যে, মধ্যে মধ্যে তাঁহার নাম স্মরণ করিয়া মাতৃহীন শিশুর ন্যায় বিলাপ ও রোদন করিতেন।

 পরিবারস্থ জনগণ পদে পদে পরপরের ইচ্ছা, রুচি ও স্বচ্ছন্দতার বিরোধী হইবার সম্ভাবনা। অতএব যাহাতে মনোভঙ্গের কারণ না ঘটে, তদ্বিষয়ে যেমন সাবধান হওয়া আবশ্যক, তেমনিই আবার ক্ষমাশীল হইতে যত্ন করাও সর্ব্বতোভাবে কর্তব্য। উগ্র স্বভাবই অসহিষ্ণুতার কারণ। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যেমন ফুৎকারে প্রজ্বলিত হইরা গ্রাম ও নগর দগ্ধ করে, সেইরূপ সামান্য কারণেও ক্রোধোদয় হইয়া, পৃথিবীতে তদপেক্ষা গুরতর বিভ্রাটই ঘটিয়া থাকে। উগ্রতাবশতঃ মুহূর্ত্ত মধ্যে যে ক্ষতি হইতে পারে, চিরজীবনে তাহার প্রতিকার হয় না। কোন কোন লোক এমন অসহিষ্ণু যে, পরিবার মধ্যে বিসম্বাদ ঘটাইয়া পরের নিকট গৃহচ্ছিদ্র প্রকাশ করিয়া দেয়। অত্যধিক উগ্রতাই তাহাদিগকে অন্ধ করিয়া ফেলে। কিন্তু কালক্রমে পরের দ্বারা নিন্দিত ও নিগৃহীত হইয়া, তাহার এই অপরিণামদর্শিতার প্রায়শ্চিত্ত করিয়া থাকে। পরিবারস্থ সকলে যাহাতে সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল হয়, ভগবতী দেবী সর্ব্বপ্রযত্নে সেই চেষ্টা করিতেন। কন্যাগণ কোন নবীনা বধূর কোন ত্রুটি উল্লেখ বা তাহার উপর দোষারোপ করলে ভগবতী দেবী বলতেন, “সংসারের সামান্য বিষয়ে এরূপ দৃষ্টি কেন? আহা! ছোট ছোট বৌগুলি মা বাপের কোল হইতে আমার কাছে আসিয়াছে। আমি যদি উহাদের মুখের