পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৬
ভগবতী দেবী

দিকে না চাহিব, তবে আর কে চাহিবে? তোমরাও আমার নিকট যেরূপ, উহারাও সেইরূপ। তোমাদের শত শত দোষ দিবারাত্রি মাপ করিতেছি, আর উহাদের দোষ কি আমি মাপ করিব না? কই, বৌমারা ত তোমাদের নামে কখন কিছু বলে না। তোমাদের দেখি কত সুখ্যাতি করে। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কি ভগিনী কোন কনিষ্ঠ ভ্রাতা কি ভগিনীকে প্রহার কি তিরস্কার করিলে, যদি সে তাঁহাকে বলিতে আসিত, তিনি বলিতেন, “অন্যায় কার্য্য করিয়াছ সেই জন্য মারিয়াছে। আর ওরূপ কার্য্য করিও না, দেখিবে কত ভাল বাসিবে।” পরিশেষে জ্যেষ্ঠ সহোদর কি জ্যেষ্ঠা ভগিনীকে সুযোগক্রমে বলিতেন, “আহা, ছোট ছোট ভাই, বোনগুলিকে ওরূপ করিয়া মার কেন? উহারা রাত দিন ‘দাদা’, ‘দিদী’, ‘দিদী’ করিয়া বেড়ায়; তোমাদের কি একটু মায়া মমতা হয় না; ওরূপ অধৈর্য্য কেন? মিষ্ট কথায় উহাদিগকে বুঝাইয়া দিলেই হয়।” এইরূপে পরিবার মধ্যে যাহাতে ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা গুণের আধিক্য পরিলক্ষিত হয় সে বিষয়ে ভগবতী দেবী বিশেষ যত্নবতী ছিলেন। পরস্পরের প্রতি পরস্পরের যাহাতে অনুরাগ বৃদ্ধি হয়, তিনি তাহারই উপায় বিধান করিতেন। ফলতঃ ভক্তি, প্রেম, প্রণয় ও স্নেহাদি অনুরাগেরই অন্তর্ভূত। ‘ইহা আমার অনুকূল’ এই জ্ঞানই অনুরাগ বা প্রীতির মূলে বর্ত্তমান এবং ইহার বাহ্য প্রকাশই উক্ত ভক্তি ইত্যাদি। কোথাও ইহার ব্যভিচার দৃষ্টিগোচর হয় না। ভক্তি, প্রেম, প্রণয় ও স্নেহাদি সকলই এই অনুরাগ মহোদধির ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা মাত্র। ভক্তি বা প্রেম উৎপত্তির পথে ভক্তিভাজন ও প্রেমাষ্পদের সৌন্দর্য্য অনুভূত হয়, অনন্তর ‘ইনিই আমার অনুকল’ এবম্বিধ জ্ঞান জন্মে; ক্রমে উহা ধারাবাহিক রূপ ধারণ করে এবং ঘনীভূত হইতে থাকে। তখনই মানব অন্যবস্তু ভুলিতে থাকে। অবিরত ঐ ছবি তাহার সম্মুখে বর্ত্তমান থাকে। অবিশ্রান্ত এই সৌন্দর্য্যময়ী ধারা চিত্তে প্রবাহিত থাকিয়া যাবতীয় পদার্থে সেই মনোমোহন রূপের সম্বন্ধ আনয়ন করিয়া তাহাকে বিচিত্র রসানুভব করাইতে থাকে। ভগবতী দেবী পুত্র ও পুত্রবধূদিগের মধ্যেও পরস্পরের সৌন্দর্য্যের অনুভূতি দ্বারা যাহাতে অনুরাগ বৃদ্ধি পায়, সে বিষয়েও সবিশেষ যত্নবতী ছিলেন।

 নবীনা বধূরা তাঁহার স্নেহ মমতায় এরপ মুগ্ধ হইয়াছিলেন যে, শ্বশুর গৃহে আসিয়া একদিনের জন্যও তাঁহারা মাতার অভাব অনুভব করিতে পারেন নাই। পিত্রালয় অপেক্ষা শ্বশুরালয়ে তাহারা পরম সুখে কালাতিপাত করিয়াছিলেন।

 ভগবতী দেবী পুত্রকন্যাদিগকে বিলাসিতা ও আত্মসুখ বিসর্জ্জন করিতে সতত শিক্ষা দিতেন। কন্যাগণকে বলিতেন, “তোমাদের বিবাহ হইলে, স্বামীর নিকট গহনা বা ভাল কাপড়ের প্রার্থনা করিও না। বরং সেই অর্থ যাহাতে পরের দুঃখমোচনে ব্যয় করিতে পার, তাহার চেষ্টা সর্ব্বতোভাবে করিবে।” ভগবতী দেবী ও ঠাকুরদাসের স্বর্ণালঙ্কারের প্রতি বিলক্ষণ দ্বেষ ছিল। তাঁহারা প্রায়ই বলিতেন, “বাটীর গ্রীলোকদিগকে অলঙ্কার দিলে, বাটীতে ডাকাইতি এবং দস্যুর