পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৮
ভগবতী দেবী

ডাকিয়া বলিতেন, “আহা, আজ বুঝি তোমার খাওয়া হয় নাই। মুখখানি শুখাইয়া গিয়াছে। এস, এস আমাদের বাটীতে এস। গরীব ব্রাহ্মণের বাটীতে ডাল ভাত প্রসাদ পাইয়া যাও।” এই কথা বলিয়া তিনি তাহাদিগকে ডাকিয়া আনিয়া খাওয়াইতেন।

 কোন বৃহৎ কার্য্য বাটীতে উপস্থিত হইলে, গ্রামের দরিদ্র স্ত্রীজন মাছের পোঁটা, কুটনার খোলা ইত্যাদি লইতে আসিলে, তিনি তৎসঙ্গে তাহাদিগকে কিছু মাছ দিতেন। ঠাকুরদাস ইহা দেখিয়া এক সময়ে বলিলেন, “তুমি এরূপ করিলে, ব্রাহ্মণ ভোজনে কম পড়িবে।” তদুত্তরে ভগবতী দেবী বলিলেন, “তোমার ব্রাহ্মণেরা ভোজন করিবেন, আর এই গরিবেরা কি ভাল জিনিষ খাইবে না?” তদবধি ঠাকুরদাস তাঁহার এইরূপ বিতরণের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করিতেন।

 ভগবতী দেবী ধর্ম্মবোধে পারিবারিক সর্ব্ববিধ কর্ম সুসম্পন্ন করিতেন। ধর্ম্মবোধেই তিনি নানারূপ ক্লেশ স্বীকার করিয়াও বিবিধ সদনুষ্ঠানে সতত নিরত থাকিতেন। তিনি দয়া ও পরোপকার জীবনের মহাব্রত বলিয়া মনে করিয়াছিলেন। তাঁহার কার্য্যে পবিত্র দেবভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। কোন সদনুষ্ঠানে তিনি কখনও গর্ব্ব প্রকাশ করেন নাই। তাঁহার মুখমণ্ডল সর্ব্বদা বিনয় ও শীলতায় শোভিত থাকিত। তাঁহার কোমল প্রকৃতি কখনও অকৃতজ্ঞতায় কলুষিত হইত না এবং তাঁহার অসামান্য দয়াও কখনও পক্ষপাতের ছায়া স্পর্শ করিত না। তিনি সকল সময়েই নিস্পাপ ও নিষ্কলঙ্ক ছিলেন। সকল সময়েই পবিত্রতার কমনীয় কান্তি তাঁহাকে গৌরবান্বিত করিয়া রাখিত। ঈশ্বরের প্রতি নির্ভরের ভাব তাঁহাকে সকল সময়েই দঢ়প্রতিজ্ঞ ও অধ্যবসায়সম্পন্ন করিয়া রাখিত। তিনি যেন প্রাণে প্রাণে উপলদ্ধি করিতেন যে, এই জগৎ মধ্যে একজন মহান সর্ব্বভারাক্রান্ত চিন্ময় কর্ত্তা সর্ব্বত্র বিদ্যমান থাকিয়া, মানুষের সঙ্গে সঙ্গে সহকারীর ন্যায় কর্ম্ম করিতেছেন। সেই সত্যনিষ্ঠ স্বভাবস্থিত পুরুষ, কোন কালবিশেষ বা স্থানবিশেষের প্রসূত নহেন। প্রত্যুত তিনি যাবৎ সংসারের কেন্দ্রবর্ত্তী; যেখানে তিনি বিদ্যমান, সেইখানেই সৃষ্টিস্থিতিশীলা; এবং তিনিই তোমার আমার ও মানবজাতির অনন্ত ঘটনাপ্রবাহের একমাত্র মানদণ্ড। এইরপ ধর্ম্মভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া তিনি সংসার সাধন করিয়াছিলেন বলিয়াই তাঁহার সংসার শান্তি-নিকেতনে পরিণত এবং ঐশ্বর্য্যশ্রীতে গৌরবান্বিত হইয়াছিল।

 সন ১২৭৬ সালের শ্রাবণ মাসের শেষে বিদ্যাসাগর ভগবতী দেবীকে কাশীবাস করিবার জন্য পিতৃসন্নিধানে পাঠাইয়া দেন। তিনি কাশীধামে ঠাকুরদাসের নিকট কতিপয় দিবস অবস্থিতি করেন। তদনন্তর অন্যান্য তীর্থস্থান পর্য্যটন করিয়া পুনর্ব্বার কাশীধামে সমুপস্থিত হন। ভগবতী দেবী ঠাকুরদাসকে বলিলেন, “এখন হইতে এখানে অবস্থিতি করা অপেক্ষা আমি দেশে অবস্থিতি করিলে, অনেক অক্ষম দরিদ্র লোককে ভোজন করাইতে পারিব। দেশে বাস করিয়া প্রতিবাসিবর্গের