পারিবারিক ধর্ম্মের মধ্যে স্ত্রীজাতির সতীত্বধর্ম্ম সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। যেমন গন্ধবিহীন পুষ্প, বিনয়বিহীন ধার্ম্মিক, মীনহীন সরোবর ও তরুহীন জনপদ অনুশোচ্য; সতীত্ববিহীন রমণীও ততোধিক অনুশোচ্য। সকল ব্রত অপেক্ষা পাতিব্রত্যব্রত অতি কঠোর। এই ব্রত আত্মোৎসর্গের পূর্ণ বিস্ফুরণ। প্রকৃত পাতিব্রত্য কেবলমাত্র বাহ্য অনুষ্ঠানে আবদ্ধ নহে; আভ্যন্তরীণ তন্ময়ত্বও সেই আভ্যন্তরীণ তন্ময়ত্বের বাহ্যক্রিয়া—এই দুইটি ইহার অঙ্গীভূত। স্থূলদর্শীরাই ধর্ম্মের বাহ্যাড়ম্বরে ভুলিয়া যান। কিন্তু ধর্ম্ম বাহিরের জিনিষ নয়। ইহা হৃদয়ের জিনিষ, প্রাণের জিনিষ, সম্ভোগের জিনিষ। যিনি সত্যধর্ম্মের আস্বাদ একবার পাইয়াছেন, তিনি ধন্য হইয়াছেন, কৃতার্থ হইয়াছেন ও অমরত্বের অধিকারী হইয়াছেন। যখন আর্য্যভূমিতে স্বয়ম্বরপ্রথা প্রচলিত ছিল—স্ত্রীজাতির আপন আপন আদশপতি নির্ব্বাচনের অধিকার ছিল,—সেই পবিত্র সরল সত্যনিষ্ঠ পুরাকালেই ভারতে সতীত্বধর্ম্মের পূর্ণ বিকাশ হইয়াছিল। সতীত্ব গুণে পতিকে দেবভাবে পূজা আর কোন দেশের মহিলা কখন করিয়াছিলেন কি না জানি না। এই সতীত্ব গুণেই ভারতললনা চিরদিন জগতের আদর্শরূপিনী।
মানুষের বহিরিন্দ্রিয় অপেক্ষা অন্তরিন্দ্রিয়ের আলোচনাই অধিক আনন্দজনক। মানবদেহ যেমন অস্থি, চর্ম্ম, মেদ ও মাংসে গঠিত, মানবাত্মাও সেইরূপ কতিপয় উপকরণে গঠিত হইয়াছে। জ্ঞান, ভাব ও ইচ্ছা, এই ত্রিবিধ চিত্তবৃত্তি অবলম্বন করিয়াই, মানবাত্মা কার্য্য করিয়া থাকে। চিন্তা, কল্পনা এবং ধারণা প্রভৃতি অদ্ভুত শক্তি মানুষের মন, এবং প্রেম, সাহস ও ভয় বিরাগাদি অত্যাশ্চর্য ভাবরাশি মনুষ্যের হদয় অসীম বৈচিত্র্যে পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছে। আবার মানুষের ইচ্ছাশক্তি কি আশ্চর্য্যরূপেই না মানুষের হৃদয় মনের অনুবর্ত্তন ও কার্য্যসাধন করিতেছে! যিনি স্থিরচিত্তে মানব মনের চিন্তাপ্রণালী, মানুষের কল্পনার কমনীয় লীলচাতুরী, মানব হৃদয়ের বিবিধ ভাবের বিচিত্র তরঙ্গমালা, এবং মানুষের ইচ্ছাশক্তির অনির্ব্বচনীয় পরাক্রম পর্য্যবেক্ষণ করিতে পারেন, পথিবীতে স্বর্গের শোভা নিরীক্ষণ করিয়া, অপার্থিব সুখ সম্ভোগ করিতে তিনিই সমর্থ।
আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, ভগবতী দেবী সংসার সাধনকেই ধর্ম্মসাধন মনে করিতেন। কিন্তু পাতিব্রত্য ধর্ম্মসাধনে তাঁহার বাহ্যাড়ম্বরের কোন পরিচয় পাই নাই। বরং ধর্ম্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ এই ভাবেরই পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। ফলতঃ ঠাকুরদাস ও ভগবতী দেবীর হৃদয়ে দাম্পত্য প্রেম যে কালের আবর্ত্তনে পরিপক্কতা প্রাপ্ত হইয়া স্নেহরসে পরিণত হইয়াছিল, পরস্পরকে প্রীতিসম্পন্ন করিয়াছিল, তাহাতে অণুমাত্র সন্দেহ নাই। পরম্পর প্রীতিসম্পন্ন দম্পতীই সর্ব্বতোভাবে অভিন্নহৃদয় হইয়া থাকিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ইহলোকে সম্পূর্ণ অভিন্নহৃদয়তা সাধিত হইয়া উঠে না। যেহেতু ভাবাগমের পন্থা বিভিন্নতা হইতেই মানুষ মধ্যে এতাদৃশ মতান্তর দৃষ্ট হইয়া থাকে।