পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পারিবারিক জীবন
৬১

একজন রূপ, আয়তন, প্রভৃতি বাহ্য গুণসম্পাতের নির্ণয় দ্বারা বস্তুসমূহকে শ্রেণীবদ্ধ করেন; অন্যজন স্বভাব-সাদশ্য বা আভ্যন্তরীণ কার্য্য কারণ সম্বন্ধ নির্ণয় করিয়া পদার্থসমূহের জাতি প্রকৃতি নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। বুদ্ধি, কিন্তু নিয়তই কারণোন্মুখী, সর্ব্বত্রই তাহাকে পরিস্ফুট ও নিরবচ্ছিন্ন দেখিতে অভিলিপ্সু; সুতরাং বহির্বৈলক্ষণ্য সতত তাহার দষ্টিগোচর হয় না। ঋষি, কবি, দার্শনিক প্রভৃতি মনীষিগণের নয়নে সকল বস্তুই মঙ্গলময় ও পুণাময়, সর্ব্বকর্ম্ম ও ঘটনা হিতকর এবং মানব মাত্রই দেবগুণসম্পন্ন। কারণ তাঁহাদের চক্ষু সতত জীবনোপরি দৃঢ় আসক্ত, অনুষঙ্গের কোনও লক্ষ্য রাখে না। আবার প্রণয়ের স্বধর্ম্ম বিষয়াবলী সমীপবর্ত্তী হইলেই, স্বকীয় বিশুদ্ধ বহ্নিতে, তাহাদিগকে পরিশুদ্ধ করিয়া লইতে চেষ্টা করে। সুতরাং দম্পতী জীবনে পরস্পরের মধ্যে সম্যক্ অভিন্নহৃদয়তা সাধিত হইয়া না উঠিলেই, অভিমান ও উদ্বেগের উদয় হইয়া কলহের সূত্রপাত করে। অন্য বিবাদস্থলে মৌনাবলম্বনই শ্রেয়ঃ, কিন্তু দম্পতী কলহে মৌনাবলম্বন সৎপরামর্শ নহে। তাহাতে কলহাগ্নি প্রজ্বলিত হইয়া উঠে, অথবা বহির্দ্দেশে নির্ব্বাণ প্রাপ্ত হইয়া অন্তরে প্রবেশপূর্ব্বক চিত্তভূমি দগ্ধ করিয়া ফেলে। যুদ্ধক্ষেত্রে স্থির থাকিয়া সম্মুখ সংগ্রাম করাই এখানকার বিধি। ঠাকুরদাস বীরপুরুষের ন্যায় সম্মুখ সংগ্রামেই অগ্রসর হইতেন।

 ভগবতী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যার বিবাহকাল উপস্থিত হইলে, ঠাকুরদাস বলিলেন, “সৎকুলীন সন্তানকে কন্যাসম্প্রদান করিব।” ভগবতী দেবী বলিলেন, “বড় ঘরে মেয়েকে বিবাহ দিতে হইবে। আমার মেয়ে যেরূপ শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়াছে, তাহাতে যদি বড় ঘরে বিবাহ হয়, তাহা হইলে এ মেয়ে স্বামীর দ্বারা জগতের অনেক মঙ্গলকার্য্য করিতে পারিবে।” এইরপ মতান্তর হইতে কথান্তর উপস্থিত হয়। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ঠাকুরদাস ভগবতী দেবীকে সুস্পষ্টরপে বুঝাইয়া বলিলেন, “দেখ, ধনবানের পুত্র হইলেই যে, সে পরোপকার ও সদাব্রতে নিরত থাকিবে এরূপ মনে করিও না। সদনুষ্ঠানের মূলে সৎপ্রবৃত্তি থাকা চাই। সদ্বংশে জন্মগ্রহণ করিলে প্রায়ই সৎ হয়। সুতরাং তাহার সৎপ্রবত্তি থাকাই সম্ভব। সৎপ্রবৃত্তি যদি থাকে, তাহ। হইলে সে ধনবান না হইলেও সদনুষ্ঠানে সতত যত্নবান্ হইবে।” পরিশেষে ভগবতী দেবী ঠাকুরদাসেরই ছন্দানুবর্ত্তিনী হন। সদ্বংশে কন্যাসম্প্রদান করা হয়। অতঃপর ঠাকুরদাস ভগবতী দেবীকে ‘মনসা’ বলিয়া ডাকিতেন।

 প্রবল ঝটিকার পরেই প্রকৃতি শান্তভাব ধারণ করে, কার্য্যের পরই বিরামের স্বভাবতঃ উদয় হয়, এবং বিপ্লবের পরেই শান্তি ও জ্ঞান মনুষ্যসমাজে দঢ়তর অধিকার স্থাপন করে। সেইরূপ দম্পতী কলহেরও চরম ফলটি অতীব মধুর। সুবোধ দান্তস্বভাব পুরুষের কার্য্য যাহাতে ঐ চরম ফলটি শীঘ্র ফলে, তাহার নিমিত্ত যত্ন করেন। অন্যান্য পারিবারিক বিষয় লইয়াও মধ্যে মধ্যে ঠাকুরদাস ও ভগবতী দেবীর মধ্যে মতান্তর উপস্থিত হইয়া কলহে পরিণত হইত। সময়ে