পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহানুভবতা ও পরার্থপরতা
৬৫

ঔষধ পাইত। বীরসিংহ, বোয়ালিয়া, পাথরা, মামদপুর প্রভৃতি সন্নিহিত গ্রামে কাহারও বাটীতে চিকিৎসা করিতে হইলে, পদব্রজে যাইয়া, বিনা ভিজিটে চিকিৎসা করিবার ব্যবস্থা ছিল। এতদ্ব্যতীত দুঃস্থ লোককে পথ্যের জন্য সাগু, বাতাসা, মিছরি প্রভৃতি দেওয়া হইত।

 তৎকালে এ প্রদেশের স্ত্রীলোকেরা লেখাপড়া শিক্ষা করিত না। বীরসিংহে সর্ব্বাগ্রে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। সকল বালিকাই বিনামূল্যে পুস্তক পাইত। বীরসিংহে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হইলে প্রতিবেশিবর্গ সন্তুষ্টচিত্তে সব সব দুহিতাদিগকে বিদ্যালয়ে পাঠাইয়া দিতেন। তজ্জন্য, সন্নিহিত অপরাপর গ্রামস্থিত লোকসকলও কোনও প্রকার আপত্তি উত্থাপন করেন নাই। বালক বিদ্যালয়ে প্রথমতঃ বাঙ্গালা এবং সংস্কৃত কাব্য ও অলঙ্কারাদির শিক্ষা দেওয়া হইত। কিছুদিন পরে অধিক সংস্কৃত সাহিত্যাদি অধ্যয়ন না করাইয়া, রীতিমত ইংরাজী ও সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হইত। বিদ্যাসাগর উক্ত বিদ্যালয়ের মাষ্টার ও পণ্ডিতের বেতন মাসিক ৩০০ টাকা প্রদান করিতেন। এতদ্ব্যতীত পুস্তকাদির জন্য মাসিক অন্ততঃ ১০০ টাকা ব্যয় হইত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরম আত্মীয় বাবু প্যারীচরণ সরকার তাঁহার ফার্ষ্ট বক, সেকেণ্ড বুক, থার্ড বুক প্রভৃতি পুস্তকগুলি বালকদিগের পাঠার্থ বিনামূল্যে দান করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, বীরসিংহে বালিকা বিদ্যালয়ে মাসে মাসে ৩০ টাকা ব্যয় করিতেন। ডাক্তারখানায়, ডাক্তার ও কম্পাউণ্ডারের বেতন এবং অন্যান্য খরচ ও ঔষধাদির মূল্য প্রভৃতিতে মাসে মাসে ১০০ টাকা ব্যয় করিতেন। নাইট স্কুলে প্রতি মাসে ১৫ টাকা ব্যয় করিতেন। বীরসিংহ বিদ্যালয়ের ও নাইট স্কুলের অনেক দরিদ্র বালক বাটীতে ভোজন করিয়া অধ্যয়ন করিবে, এইরূপ ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত বিদেশস্থ অনেক ব্রাহ্মণ তনয়কে নিজ বাটীতে অন্ন দিয়া, বীরসিংহ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করাইতেন। ন্যূনাধিক ৬০ জন বালক বাটীতে ভোজন করিয়া লেখাপড়া শিক্ষা করিত। মধ্যে মধ্যে ঠাকুরদাস বলিতেন যে, আমি বাল্যকালে বিলক্ষণ অন্নকষ্ট পাইয়াছি, অতএব অন্নব্যয় করা আমার সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান কর্ম্ম। তিনি কুমারগঞ্জের হাটে যাইয়া দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া আনিতেন। ছাত্রসকলকে এবং পুত্র, পৌত্র, দৌহিত্রদিগকে একত্র বসাইয়া আহার করাইতেন। ভগবতী দেবী সতুষ্টচিত্তে স্বয়ং রন্ধন পরিবেশনাদি কার্য্য প্রতিদিন সমভাবে নির্ব্বাহ করিতেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যখন ৫০০ টাকা বেতন হয়, তখন তিনি এক সময়ে কার্য্যোপলক্ষে দেশে আগমন করিয়া মাতাকে জিজ্ঞাসা করেন, “মা, আর তোমার মনে কি সাধ আছে আমায় বল।” ভগবতী দেবী বলিলেন, “বাবা, এইবার যেখানে যত দুঃস্থ আত্মীয় স্বজন আছেন, তাঁহাদের একটা মাসহারার ব্যবস্থা করিয়া দাও।” বিদ্যাসাগর মহাশয় মাতার অভিলাষানুযায়ী আত্মীয় স্বজনের মধ্যে যাঁহাদের হীন অবস্থা ছিল, এমন কি সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করা সুকঠিন