পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
লোকানুরাগ ও সেবাধর্ম্ম
৬৭

যাহারা নিত্য মজুরি করিয়া দিনপাত করিত, তাহাদের দিনপাত হওয়া সুকঠিন এই সময়ে টাকায় পাঁচ সের চাউল বিক্রয় হইত, তাহাও সকল সময়ে দুষ্প্রাপ্য। মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র এই তিন মাস অনেকেই ঘটী বাটি ও অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া কথঞ্চিৎ প্রাণধারণ করে। পরে চাউল ক্রয়ে অপারক হইয়া, কেহ কেহ বুনো ওল ও কচু খাইয়া দিনপাত করে এবং নানাপ্রকার কষ্টভোগ করিয়া অনাহারে অকালে কালগ্রাসে নিপতিত হয়। শত শত ব্যক্তি সমস্ত দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া উদরের জ্বালায় কলিকাতায় প্রস্থান করিয়াছিল ও তথায় পথে পথে ভিক্ষা করিয়া উদরপূর্ত্তি করিত। ৭৩ সালের বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে জাহানাবাদ মহকুমায় প্রায় অশীতি সহস্র লোক অন্নাভাব প্রযুক্ত কলিকাতায় যাইয়া তথাকার অন্নসত্রে ভোজন করিত। তংকালে কেহ জাতিবিচার করে নাই। জননী সন্তানকে পথে ফেলিয়া দিয়া কলিকাতায় প্রস্থান করেন। অনেক কুলকামিনী জাত্যাভিমানে জলাঞ্জলি দিয়া জাত্যন্তরিতা হয়। চতুর্দ্দিকেই হাহাকার শব্দ, কেহ কাহারও প্রতি দয়া প্রকাশ করে নাই, সকলেই অন্নচিন্তায় ব্যাকুল হইয়াছিল।

 বীরসিংহবাসী অধিকাংশ লোক প্রাতঃকাল হইতে রাত্রি ১০টা পর্য্যন্ত বিদ্যাসাগরের দ্বারে দণ্ডায়মান থাকিত। তাহাদিগকে ভোজন না করাইয়া কেহ ভোজন করিতে পারিতেন না। কোন কোনও দিন রাত্রিতেও সন্নিহিত গ্রামের ভদ্রলোকগণ উদরের জ্বালায় দ্বারে দ্বারে উপস্থিত হইয়া চীৎকার করিতেন, তাঁহাদিগকে ভোজন না করাইলে সমস্ত রাত্রই চীৎকার করিতেন। এইরূপ বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে প্রায় শতাধিক নিরন্ন ব্যক্তি ক্ষুধার জ্বালায় দিবারাত্রি চীৎকার করিয়া বেড়াইত।

 ক্রমে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাটীর চতুর্দ্দিকে বিদেশী ও স্বদেশস্থ অসংখ্য দীন দুঃখী সমবেত হইতে লাগিল। করুণাময়ী, দীনজননী সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা ভগবতী দেবী কি আর স্থির থাকতে পারেন? নিরন্ন দীনহীন সন্তানগণের মর্ম্মভেদী চীৎকারধ্বনিতে দীন জননীর কোমল হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া গেল। সাক্ষাৎ অন্নপুর্ণা ভগবতী দেবী অন্নহীনজনের অন্নদানার্থ অন্নসত্রের প্রতিষ্ঠা করিলেন। প্রথমতঃ তিনি স্বয়ং রন্ধন করিয়া অন্নসত্রের দুর্ভিক্ষপীড়িত লোকদিগকে ভোজন করাইতেন। তাহাদিগের ভোজনের সময় তিনি তথায় উপস্থিত থাকিতেন। তাহারা যেরূপ আগ্রহ ও আনন্দের সহিত ভোজন করিত, সে দৃশ্য যেন তাঁহার হৃদয়ের অন্তস্থল স্পর্শ করিত। হৃদয়ের প্রবল আবেগ তিনি আর সম্বরণ করিতে পারিতেন না। তাঁহার গণ্ডস্থল বহিয়া প্রবল বেগে অশ্রুধারা নিপতিত হইত। এ দৃশ্য কি মধুর। কি হৃদয়স্পর্শী! ভগবতী দেবী একদিন ঠাকুরদাসকে যে বলিয়াছিলেন, “সেই আমার কাশী, সেইখানেই আমার বিশ্বেশ্বর।” পাঠকগণ, চক্ষু থাকে নিরীক্ষণ করুন, হৃদয় থাকে অনুভব করুন, ক্ষুদ্র বীরসিংহ পল্লী সত্য সত্যই আজ কাশীধামে পরিণত হইয়াছে কি না? কাশীধামের অন্নদাত্রী