বন্ধুবর্গ লইয়া কপাটী খেলা আরম্ভ করিলেন। দারোগাবাবু, ফাঁড়িদারকে বলিলেন, “এ বামুনের (ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের) এত কি জোর যে, আমি দারোগা, আমার মুখের উপর জবাব দেয় যে একপয়সাও দিব না। অতি আশ্চর্য্যের বিষয় যে, এই ছোঁড়াটা কি রকমের লোক? কাল ডাকাইতি হইয়াছে, আজ সকালে বাটীর সম্মুখে কপাটি খেলিতেছে।” ফাঁড়িদার বলিল, “হুজুর ইনি সামান্য লোক নহেন। ইনি দেশে আসিলে, জাহানাবাদের ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট্ বাবু ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল, বন্ধুভাবে এখানে আসিয়া ইঁহার সহিত সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া, আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করেন। এবং শুনা যায় যে, বড়লাট ও ছোটলাট সাহেবের সহিত ইঁহার বন্ধুত্ব আছে। ইঁহার মত লইয়া জজ ম্যাজিস্ট্রেট্ বাহাল হয়।” ইহা শুনিয়া দারোগাবাবু, স্তব্ধ হইয়া শান্তভাবে কার্য্য করিলেন। কিন্তু ডাকাইতির কোন সন্ধান হইল না।
সন ১২৭৫ সালের চৈত্র মাসে আর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা উপস্থিত হয়। বীরসিংহের পৈতৃক বাসভরন নিশীথ সময়ে অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত হয়। সকলেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। অগ্নি যখন চতুর্দ্দিকে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিয়াছে, তখন সকলের নিদ্রাভঙ্গ হইল। তখন সম্মুখে যে যাহা পাইল, তাহা লইয়া প্রাণভয়ে মুহর্ত্ত মধ্যে গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল। বাহিরে আসিয়া ভগবতী দেবীর মনে পড়িল, কনিষ্ঠ পুত্র ভূতনাথ গৃহে নিদ্রিত। তখন তিনি আর্দ্র কন্থায় গাত্র আবৃত করিয়া সেই প্রজ্বলিত গৃহ মধ্যে দ্রুতপদে প্রবেশ করিলেন এবং সুপ্ত সন্তানকে জাগরিত করিয়া তাহাকে ক্রোড়ে লইলেন এবং সেই কক্ষে গহনার বাক্স রহিয়াছে দেখিতে পাইয়া, পুত্র ও সেই গহনার বাক্স লইয়া দ্রুতপদে বহির্গত হইলেন। তিনি স্বয়ং বলিয়াছেন, “আসিবার সময় কে যেন আমার পথ মুক্ত করিয়া আমাকে জোর করিয়া বাহির করিয়া দিল। সকলের জীবন রক্ষা হইয়াছিল বটে, কিন্তু দ্রব্যাদি কিছুমাত্র রক্ষা হয় নাই। বিদ্যাসাগর এই সংবাদ প্রাপ্তি মাত্র দেশে আগমন করিলেন। মাতৃদেবীকে সমভিব্যাহারে লইয়া কলিকাতায় যাইবার জন্য যত্ন পাইলেন। কিন্তু তিনি যলিলেন, “আমি কলিকাতায় যাইব কারণ যে সকল ছাত্রগণ বাটীতে ভোজন করিয়া বীরসিংহ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে, আমি এ স্থান পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করিলে, তাহারা কি করিয়া স্কুলে অধ্যয়ন করিবে। কে দরিদ্র বালকগণকে স্নেহ করিবে? বেলা দুই প্রহরের সময় অতিথিসকল ভোজন করিবার মানসে এখানে সমাগত হইলে, কে অভ্যর্থনাপূর্ব্বক তাহাদিগের পরিচর্য্যা করিবে? যে সকল কুটুুম্ব আগমন করিবেন কে তাঁহাদিগকে যত্ন করিয়া ভোজন করাইবে?” ভগবতী দেবী কলিকাতায় যাইতে সম্মত হইলেন না। জন্য বিদ্যাসাগর তাঁহার স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। বর্ষাকাল সমাগত; একারণ বিদ্যাসাগর তাহার বাসার্থ সামান্য গৃহ নির্ম্মাণ করাইয়া দিলেন।