পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮২
ভগবতী দেবী

গৃহস্থোচিত পূজা, সন্ধ্যা বন্দনাদিতে অতিবাহিত করিতেন। যখন তিনি সেবাধর্ম্মানুষ্ঠানে নিরত থাকিতেন, তখন তাঁহাকে দেখিলে মনে হইত, তিনি যেন আর ইহজগতের জীব নহেন। এই সময়ে তিনি একেবারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইয়া যাইতেন। এবং যেন ভগবৎসেবা করিতেছেন এই ভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া তিনি জীবসেবা করিতেন। এই সকল বিষয় পর্য্যালোচনা করিলে আমাদের মনে হয়, দিবাযামিনীর অধিকাংশ সময় তিনি নির্জ্জনবাসজনিত শান্তি উপভোগ করিতে পারিতেন। তিনি এইরূপে সময়ের সদ্ব্যবহার করিয়াছিলেন বলিয়াই, অদ্যাপি বীরসিংহ ও তন্নিকটবন্তী গ্রামসমূহের অধিবাসিদের নিকট তাঁহার নামোচ্চারণ করিবামাত্র, তাঁহারা অশ্রুবিসর্জ্জন করিতে করিতে আবেগময়ী ভাষায় তাঁহার অশেষ গুণনকীর্ত্তন করিয়া থাকেন। তিনি মরিয়াও অমরত্ব লাভ করিয়াছেন।


চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ॥ মহত্ত্ব ও মিতাচার

 কোন বিষয়েরই আতিশয্য বাঞ্ছনীয় নহে। সামঞ্জস্য রক্ষা করা প্রাকৃতিক নিয়মের এক প্রধান লক্ষণ। সমঞ্জসীভূত উন্নতি সাধনই মানব জীবনের লক্ষ্য হওয়া কর্ত্তব্য। সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীন গ্রীক বিজ্ঞানবেত্তা অরিস্ততল মিতাচারকেই ধর্ম্ম বলিয়া গিয়াছেন। তাঁহার মতে সকল বিষয়ের মধ্যম ভাবই ধর্ম্ম। কি শারীরিক স্বাস্থ্যবিধান, কি ধর্ম্মপার্জ্জন, কি খ্যাতিলাভ, কি ন্যায়ানুগত কর্ম্মবিধান, কোনও বিষয় মিতাচার ব্যতিরেকে সুসম্পন্ন হয় না। মিতাচারী, তাঁহার ক্ষোভের কারণ অতি অল্প, তাঁহার হৃদয় প্রায়ই শান্তিরসাভিষিক্ত, তাঁহার মন সর্ব্বদাই প্রফুল্ল, তাঁহার শরীর সুস্থ ও কার্য্যক্ষম।

 উচ্চাভিলাষ, মনস্বিতা, সাহস, শৌর্য্য, দয়া প্রভৃতি মনের উচ্চতাবসকল মহত্ত্বের প্রকৃষ্ট উপাদান বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। যেখানে মহত্ত্বের উপাসনা, সেইখানেই প্রীতি ও ভক্তি বিরাজমান। এই প্রীতি ভক্তিই পরার্থে আত্মশাসন ও পরার্ধে আত্মসুখ বিসর্জ্জন শিক্ষা দেয়। আবার মহত্ত্বের এই দুই মূল মন্ত্রের মূলেই মিতাচার বিদ্যমান রহিয়াছে। সুতরাং মহত্ত্ব ও মিতাচার আপাততঃ পরস্পর বিভিন্ন বিষয় বলিয়া বিবেচিত হইলেও মূলে এতদুভয় বিশেষ রূপ ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ। ভগবতী দেবীর জীবনে আমরা যে মহত্ত্বের পরিচয় পাই, তাহার মূলে কি পরিমাণে মিতাচার বিদ্যমান রহিয়াছে, তাহাই আমাদের বর্ত্তমান অধ্যায়ের প্রধান আলোচ্য বিষয়।

 ভগবতী দেবীর অন্নদান ব্যাপার তাঁহার নিত্য নৈমিত্তিক ক্রিয়ার মধ্যেই পরিগণিত হইয়াছিল। কিন্তু তিনি কখন যোড়শোপচারে অন্নদানের ব্যবস্থা করিতে যত্নবতী হন নাই। তিনি যেন ইহা উপলদ্ধি করিতে পারিয়াছিলেন যে,