পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৪
ভগবতী দেবী

ফিতা ও সূতা যত্ন করিয়া তুলিয়া রাখিতেন। তাঁহার পরলোক গমনের পর ঐ সকল সূতা ও ফিতার মূল্য ১১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা ধার্য্য হইয়াছিল। যাঁহার রাজ্যে কখন সূর্য্যাস্ত হয় না, সেই প্রবল প্রতাপান্বিতা, ইংলণ্ডের সৌভাগ্যলক্ষ্মী, রাজরাজেশ্বরী, পূণ্যশীলা ভিক্টোরিয়া যখন মিতাচারিণী ছিলেন, তখন আমাদের সামান্য গৃৃহস্থ গৃহে কিরূপ মিতাচার অবলম্বনের প্রয়োজন, পাঠকগণ, একবার ধীরচিত্তে এ বিষয়ে পর্য্যালোচনা করিবেন।

 যে সকল বালক গৃহে ভোজন করিয়া বীরসিংহ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিত, তাহাদের ভোজনাতে উচ্ছিষ্ট অন্ন পাত্রে পরিত্যক্ত থাকিত। ভগবতী দেবী কন্যাদিগকে সেই সকল উচ্ছিষ্ট অন্ন যত্ন সহকারে রক্ষা করিতে বলিতেন। এবং পরিশেষে তিনি পরম সন্তোষপূর্ব্বক সেই সকল অন্ন ভোজন করিতেন। এইরূপে অনেকদিন ঐ উচ্ছিষ্ট অন্ন দ্বারাই তাহার উদরপূর্ত্তি হইত। তাঁহার দেবী চরিত্রের আখ্যায়িকা যতই পর্যালোচনা করা যায়, ততই উপলদ্ধি করা যায় যে, তাঁহার পথে আত্মশাসন ও পরার্থে আত্মসুখ বিসর্জ্জনের মূলে মিতাচারই, বিদ্যমান ছিল।


পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ॥ সন্তানবাৎসল্য

 ভগবতী দেবীর ন্যায় উন্নতহৃদয়া, উদারপ্রকৃতি গুণবতী রমণী সচরাচর দৃষ্টিগোচর হয় না। এমন মা না হইলে কি বিদ্যাসাগরের ন্যায় পুত্র জন্মে? মাতার সেই উন্নত হৃদয়ভাব সম্পূর্ণরূপে বিদ্যাসাগরে সংক্রামিত হইয়াছিল। তাঁহার ন্যায় মাতৃভক্ত পুত্রও অতি বিরল। বৃদ্ধ বয়সেও মাতার নাম করিলে তাঁহার চক্ষুদ্বয় অশ্রুপূর্ণ হইত। কেহ তাঁহার নিকট ভিক্ষা করিতে আসিয়া যদি বলিত, ‘আমার মা নাই', তাহা হইলে অশ্রুধারায় তাঁহার বক্ষঃস্থল প্লাবিত হইত। ‘মা’ নাম শ্রবণ করিলে বিদ্যাসাগর মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় হইতেন। ‘মা' নামই যেন তাঁহার জীবনের সাধন মন্ত্র ছিল। তিনি সঙ্গীতবিদ্যা জানিতেন না। কিন্তু যে সঙ্গীতে ‘মা’ নাম আছে, সেই সঙ্গীত শ্রবণ করিতে তিনি অতিশয় ভাল বাসিতেন। ‘মা’ নামপূর্ণ সঙ্গীত শ্রবণে তাঁহার ভক্তিপ্রবণ হৃদয়ের ভক্তিরস উদ্বেল হইয়া উঠিত। গণ্ডস্থল বহিয়া প্রবলবেগে অশ্রুধারা নিপতিত হইত। এই মাতাপিতৃভক্ত ঈশ্বরচন্দ্রই একদিন কাশীধামের ব্রাহ্মণদিগকে মাতাপিতার উদ্দেশে বলিয়াছিলেন, ‘তোমাদের বিশ্বেশ্বর, অন্নপূর্ণা কি তাহা আমি জানি না। আমার বিশ্বেশ্বর এই−আর আমার অন্নপূর্ণা এই।” বিদ্যাসাগর আজীবন প্রত্যুষে শয্যা,ত্যাগ করিয়া মাতাপিতার প্রতিকৃতি প্রণাম না করিয়া গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত, হইতেন না।