পাতা:বিবিধ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৯).pdf/৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আৰ্য্যজাতির সূক্ষ্ম শিল্প ዕቁ কাব্য, সঙ্গীত, নৃত্য, ভাস্কৰ্য্য, স্থাপত্য এবং চিত্র, এই ছয়টি সৌন্দৰ্য্যজনিক বিদ্যা । ইউরোপে এই সকল বিদ্যার যে জাতিবাচক নাম প্ৰচলিত আছে, তাহার অনুবাদ করিয়া “সূক্ষ্মশিল্প” নাম দেওয়া হইয়াছে। সৌন্দৰ্য্যপ্ৰসূতি এই ছয়টি বিদ্যায় মনুষ্যজীবন ভূষিত ও সুখময় করে। ভাগ্যহীন বাঙ্গালির কপালে এ সুখ নাই। সূক্ষ্ম শিল্পের সঙ্গে তাহার বড় বিরোধ। তাহাতে সাঙ্গালির বড় অনাদর, বড় ঘূণা। বাঙ্গালি সুখী হইতে জানে না । স্বীকার করি, সকল দোষটুকু বাঙ্গালির নিজের নহে। কতকটা বাঙ্গালির সামাজিক রীতির দোষ ;-পূর্বপুরুষের ভদ্রাসন পরিত্যাগ করা হইবে না, তাতেই অসংখ্য সন্তান সন্ততি লইয়া গৰ্ত্তমধ্যে পিপীলিকার ন্যায়, পিল পিল করিতে হইবে-সুতরাং স্থানাভাব্যবশতঃ পরিস্কৃতি এবং সৌন্দৰ্য্যসাধন সম্ভবে না। কতকটা বাঙ্গালির দারিদ্র্যজন্য । সৌন্দৰ্য্য অর্থসাধ্য-অনেকের সংসার চলে না। তাহার উপর সামাজিব রীত্যনুসারে আগে পৌরস্ত্রীগণের অলঙ্কার, দোলদুর্গোৎসবের ব্যয়, পিতৃশ্ৰাদ্ধ, মাতৃশ্ৰাদ্ধ পুত্র কন্যার বিবাহ দিতে অবস্থার অতিরিক্ত ব্যয় করিতে হইলে-সে সকল ব্যয় সম্পন্ন করিয়া, শূকরশালা তুল্য কদৰ্য স্থানে বাস করিতে হইবে, ইহাই সামাজিক রীতি, ইচ্ছা করিলেও সমাজশৃঙ্খলে বদ্ধ বাঙ্গালি, সে রীতির বিপরীতাচরণ করিতে পারেন না। কতকটা হিন্দুধৰ্ম্মের দোষ ; যে ধৰ্ম্মানুসারে উৎকৃষ্ট মৰ্ম্মরপ্রস্তুত হৰ্ম্ম্যও গোময় লেপনে পরিষ্কৃত করিতে হইবে, তাহার প্রসাদে সূক্ষ্ম শিল্পের দুর্দশারই সম্ভাবনা । এ সকল স্বীকার করিলেও দোষীক্ষালন হয় না । যে ফিরিঙ্গি কেরাণীগিরি করিয়া শত মুদ্রায় কোন মতে দিনপাত করে, তাহার সঙ্গে বৎসরে বিংশতি সহস্র মুদ্রার অধিকারী গ্ৰাম্য ভূস্বামীর গৃহপারিপাট্য বিষয়ে তুলনা কর। দেখিবে, এ প্রভেদটি অনেকটাই স্বাভাবিক। দুই চারি জন ধনাঢ্য বাবু, ইংরেজদিগের অনুকরণ করিয়া, ইংরেজের ন্যায় গৃহাদির পারিপাট্য বিধান করিয়া থাকেন এবং ভাস্কৰ্য্য ও চিত্ৰাদির দ্বারা গৃহ সজ্জিত করিয়া থাকেন। বাঙ্গালি নকলনবিশ ভাল, নাকলে শৈথিল্য নাই। কিন্তু তঁহাদিগের ভাস্কৰ্য্য এবং চিত্রসংগ্ৰহ দেখিলেই বোধ হয় যে, অনুকরণ-স্পৃহাতেই ঐ সকল সংগ্ৰহ ঘটিয়াছে—নচেৎ সৌন্দৰ্য্যে তঁাহাদিগের আন্তরিক অনুরাগ নাই। এখানে ভাল মন্দের বিচার নাই, মহার্ঘ্য হইলেই হইল ; সন্নিবেশের পারিপাট্য নাই, সংখ্যায় অধিক হইলেই হইল। ভাস্কৰ্য্য চিত্র দূরে থাকুক, কাব্য সম্বন্ধেও বাঙ্গালির উত্তমাধ্যম বিচার শক্তি দেখা যায় না। এ বিষয়ে সুশিক্ষিত অশিক্ষিত সমান-প্ৰভেদ অতি অল্প । নৃত্য গীত—সে সকল বুঝি বাঙ্গালা হইতে উঠিয়া গেল। সৌন্দৰ্য্যবিচারশক্তি, সৌন্দৰ্য্যরসাস্বাদন সুখ, বুঝি বিধাতা বাঙ্গালির কপালে লিখেন নাই ।