পাতা:বিবিধ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৯).pdf/৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শকুন্তলা, মিরান্দা এবং দেসুন্দিমোনা b^○ তাই বলিতেছিলাম যে, শকুন্তলা দেসন্দিমোনার সঙ্গে তুলনীয়া এবং তুলনীয়াও নহে। তুলনীয়া নহে-কেন না, ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় বস্তুতে তুলনা হয় না। সেক্ষপীয়রের এই নাটক সাগরবৎ, কালিদাসের নাটক নন্দনকাননতুল্য। কাননে সাগরে তুলনা হয় না। যাহা সুন্দর, যাহা সুদৃশ্য, যাহা সুগন্ধ, যাহা সুরব, যাহা মনোহর, যাহা সুখকর, তাহাই এই নন্দনকাননে অপৰ্য্যাপ্ত. তুপীকৃত, রাশি রাশি, অপরিমেয়। আর যাহা গভীর, দুস্তর, চঞ্চল, ভীমনার্দী, তাহাই এই সাগরে ৷ সাগর বুৎ সেক্ষপীয়রের এই অনুপম নাটক, হৃদয়োখিত বিলোল তরঙ্গমালায় সংক্ষুব্ধ ; দুরন্ত রাগ দ্বেষ ঈর্ষাদি বাত্যায় সন্তাড়িত ; ইহার প্রবল বেগ দুরন্ত কোলাহল, বিলোল উম্মিলীলা,-“আবার ইহার মধুর নীলিমা, ইহার অনন্ত আলোকচূর্ণ প্ৰক্ষেপ, ইহার জ্যোতিঃ, ইহার ছায়া, ইতার রত্বরাজি, ইহার মুদু গীতি-সাহিত্যসংসারে দুর্লভ | তাই বলি, দেস্দিমোনা শকুন্তলায় তুলনীয় নহে। ভিন্ন জাতীয়ে ভিন্ন জাতীয়ে তুলনীয়া নহে। ভিন্ন জাতীয় কেন বলিতেছি, তাহার কারণ আছে। ‘ভারতবর্ষে সাপ্তাকে নাটক বলে, ইউরোপে ঠিক তাহাকেই নাটক বলে না। উভয় দেশীয় নাটক দৃশ্যকাব্য বটে, কিন্তু ইউরোপীয় সমালোচকেরা নাটকার্থে আর একটু অধিক বুঝেন । তঁাহারা বলেন যে, এমন অনেক কাব্য আছে—যাহা দৃশ্যাকাব্যের আকারে প্রণীত, অথচ প্ৰকৃত নাটক নহে । নাটক নহে বলিয়া যে এ সকলকে নিকৃষ্ট কাব্য বলা যাইবে, এমত "হে। —তন্মধ্যে অনেকগুলি অত্যুৎকৃষ্ট কাব্য, যথা গেটে-প্রণীত ফষ্ট এবং বাইরণ-প্ৰণীত মানফ্রেড-কিন্তু উৎকৃষ্ট হটক, নিকৃষ্ট হউক।--ঐ সকল কাব্য, নাটক নহে। সেক্ষপীয়রের টেম্পেষ্ট এবং কালিদাসকৃত শকুন্তলা, সেই শ্রেণীর কাব্য, নাটকাকারে অত্যুৎক্লষ্ট উপাখ্যান কাব্য ; কিন্তু নাটক নহে। নৰ্টক নহে বলিলে এতদুভয়ের নিন্দ হইল না ; কেন না, এরূপ উপাখ্যান কাব্য পৃথিবীতে অতি বিরল-অতুলা বলিলে হয়। আমরা ভারতবর্ষে উভয়কেই নাটক বলিতে পারি ; কেন মা, ভারতীয় অলঙ্কারিকদিগের মতে নাটকের যে সকল লক্ষণ, তাহা সকলই এই দুই কাব্যে আছে। কিন্তু ইউরোপীয় সমালোচকদিগের মতে নাটকের যে সকল লক্ষণ, এই দুই নাটকে তাহা নাই। ওথেলো নাটকে তাহা প্রচুর পরিমাণে আছে । ওথেলো নাটক—শকুন্তলা এ হিসাবে উপাখ্যান কাব্য। ইহার ফল এই ঘটয়াছে যে, দেসন্দিমোনা-চরিত্র যত পরিস্ফুট হইয়াছে।--মিরান্দা বা শকুন্তলা তেমন হয় নাই। দেসন্দিমোনা সজীব, শকুন্তলা ও মিরান্দা ধ্যানপ্রাপ্য। দেসুন্দিমোনার বাক্যেই তাহার কাতর, বিকৃত কণ্ঠস্বর আমরা শুনিতে পাই, চক্ষের জল ফেঁাটা ফোটা গণ্ড বহিয়া বক্ষে পড়িতেছে দেখিতে পাই-ভুলগ্নজানু সুন্দরীর স্পন্দিততার লোচনের উৰ্দ্ধ দৃষ্টি