কবি-কল্পনার গৌরব কোথায়? আমাদের সমাজে যে নিদারুণ অবিচার প্রতিনিয়ত ঘটিতেছে, সাহিত্যে যদি তাহারই পুনরাবৃত্তি দেখি, তবে মানুষহিসাবে মানুষের মূল্য স্বীকার করা সম্বন্ধে হতাশ হইতে হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে রোহিণীর দুর্গতির কথা যখন ভাবি, তখন আমার নিরুদিদির কথা মনে হয়। সে গল্প তোমাকে বলি। নিরুদিদি ছিলেন ব্রাহ্মণের মেয়ে, বালবিধবা। বত্রিশ বৎসর বয়স পর্য্যন্ত তাঁহার চরিত্রে কোন কলঙ্ক স্পর্শ করে নাই। গ্রামে এমন সুশীলা, ধর্ম্মমতি, পরোপকারিণী, শ্রমশীলা ও কর্ম্মিষ্ঠা আর কেহ ছিল না; রোগে সেবা, দুঃখে সান্ত্বনা, অভাবে সাহায্য, এমন কি অসময়ে দাসীর ন্যায় পরিচর্য্যা, তাঁহার নিকটে পায় নাই এমন পরিবার বোধ হয় সে গ্রামে একটিও ছিল না। আমার বয়স তখন অল্প, তথাপি তাঁহাকে দেখিয়া আমার একটা বড় উপকার হইয়াছিল—আমি একটা বড় হৃদয়ের পরিচয় পাইয়াছিলাম। এতকাল পরে, সেই বত্রিশ বৎসর বয়সে নিরুদিদির পদস্খলন হইল। গ্রামের স্টেশনের এক বিদেশী রেল-বাবু সেই আজন্ম ব্রহ্মচারিণীর কুমারীহৃদয় যে কি মন্ত্রে বিদ্ধ করিয়াছিল, তাহা সেই পাষণ্ডই জানে—যে শেষে তাঁহাকে কলঙ্কের প্রকাশ্য অবস্থায় ফেলিয়া পলায়ন করিল। সে অবস্থায় সচরাচর যে একমাত্র উপায়, নিরুদিদিকেও তাহাই করিতে হইল। ইহার পরে, এমন যে স্বাস্থ্য তাহা একেবারে ভাঙিয়া পড়িল। অবশেষে তিনি মরণাপন্ন হইয়া শয্যাশায়ী হইলেন, মুখে একটু জল দেওয়া তো পরের কথা, কেহ তাঁহার দুয়ার মাড়াইত না। যে সকলের সেবা করিয়াছে, যাহার যত্নে শুশ্রূষায় কত লোক মৃত্যুমুখ হইতে বাঁচিয়াছে, সে আজ একটা গৃহপালিত পশুর অধিকারেও বঞ্চিত হইল। আমাদের বাড়িতেও কড়া হুকুম ছিল,
পাতা:বিবিধ কথা.djvu/১৬৮
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শরৎ-পরিচয়
১৫৫