বাঁচাইয়া আত্মাকে বিনাশ করিয়াছে—তাহার হৃদয়ের মূলগ্রন্থি ছিঁড়িয়া দিয়াছে; তাই আজ আর ধর্ম্ম অধর্ম্ম, মান অপমান, প্রেম অপ্রেম— কোন সংস্কারই তাহার নাই; যাহাকে তাহার ত্রিভুবনের এক দেবতা বলিয়া সে বিশ্বাস করিয়াছিল, তাহার মধ্যেও নারীমাংসলোলুপ অতিশয় সাধারণ দুশ্চরিত্র লম্পটকেই সে দেখিয়াছে। তাই বারুণী পুষ্করিণীর সোপানে বসিয়া গভীর জলতলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া যে রোহিণী একদিন জীবন অপেক্ষা মৃত্যুকে শীতল মনে করিয়াছিল— আজ যে সেই রোহিণী কুক্কুরীর মত হইয়াও বাঁচিয়া থাকিতে চায়, ইহাতেই বুঝিতে পারি, গোবিন্দলাল কত বড় পাপ করিয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্র রোহিণীর সেই দগ্ধ অঙ্গার-মূর্ত্তিই দেখাইয়াছেন— দহ্যমান অবস্থা দেখান নাই; শেষে তাহারই এক মুষ্টি ভস্মাবশেষ ফুঁ দিয়া উড়াইয়া দিয়াছেন। তাঁহার লক্ষ্য তখন গোবিন্দলাল, রোহিণী উপলক্ষ্য মাত্র। কল্পনার এই কেন্দ্র পরিবর্ত্তনের কথা আগে বলিয়াছি—ইহাই রচনাহিসাবে এ গ্রন্থের গুরুতর ত্রুটি। তথাপি রোহিণীকে হত্যা করিবার সময় গোবিন্দলালের মুখে যখন শুনি—‘তুমি কে রোহিণী, যে তোমার জন্য’ ইত্যাদি ইত্যাদি, তখন এই নিতান্ত থিয়েটারী বক্তৃতার মধ্যে গোবিন্দলালের মিথ্যাবাদই উচ্চরব করিয়া উঠে; যাহাকে সে এতটুকু স্নেহ করে নাই, যাহার প্রতি সে-ই বিশ্বাসঘাতকতার চূড়ান্ত করিয়াছে, যাহার কৃতজ্ঞতার প্রতি তাহার এতটুকু দাবি নাই, তাহাকেই বিশ্বাসঘাতিনী বলিয়া আপনার পাপ তাহার উপরে চাপাইয়া, সে তাহার দণ্ডদাতা হইয়াছে! বঙ্কিমচন্দ্রের কোন উপন্যাসে, নায়কস্থানীয় পুরুষ-চরিত্রের এত বড় অধঃপতন—এত বড় আত্মঘাতী প্রমত্ততা ও তাহার এমন নিদারুণ পরিণাম চিত্রিত হয় নাই। আমার মনে হয়, কল্পনার এই উগ্র একাগ্রতায় কবিরও কিঞ্চিৎ বিভ্রম
পাতা:বিবিধ কথা.djvu/১৭৪
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শরৎ-পরিচয়
১৬১
