সমগ্রতাবোধের প্রয়োজন আছে, নতুবা রসোপলব্ধি হয় না; এবং এইরূপ সমগ্রতাবোধের কিছু সাহায্য হয় কবিচিত্ত ও কবিজীবনের পরিচয় হইতে। শরৎচন্দ্রের বিষয়ে আমার সেই পরিচয় খুব বেশি নয়, তথাপি আমার পক্ষে সেইটুকুই বরাবর কাজে লাগিয়াছে।
শরৎচন্দ্র জীবনকে একটা ক্ষেত্রে মুখামুখি দেখিয়াছিলেন—সেই দেখারও একটা ব্যক্তিগত ভঙ্গি আছে। যে প্রবৃদ্ধ কল্পনাশক্তি কবিকে নৈর্ব্যক্তিক করিয়া তোলে, শরৎচন্দ্রের তাহা ছিল না,—কল্পনা অপেক্ষা অনুভূতির প্রখরতাই ছিল তাঁহার অধিক, তাই তাঁহার সৃষ্টির ভাব-রূপ যত পরিস্ফুট, তাহার পরিধি তেমন বিস্তৃত নয়। শূলবিদ্ধ বৃশ্চিক যেমন যন্ত্রণায় আপনার দেহ আপনি দংশন করে, সে দংশনে আত্মমমতাই প্রবল—শরৎচন্দ্রও তেমনই আমাদের এই সমাজের সহিত একাত্ম হইয়াই তাহার যন্ত্রণা পরম মমতার সহিত নিজদেহে ভোগ করিয়াছেন। তিনি বিচারক নহেন, সংস্কারকও নহেন—তিনি কেবল এই ব্যথার কাব্যকার। তিনি আগামী সভ্যতা ও সমাজনীতির ভাবনা তেমন ভাবেন নাই, যেমন ভাবিয়াছেন—এক যুগের সমাজ-ব্যবস্থার ফলে এক শ্রেণীর মানব-মানবীর অন্তর মন্থিত অমৃত-গরলের কথা। সেই সমাজব্যবস্থার দোষ ও গুণ তিনি সমভাবে গ্রহণ করিয়াছেন—সকল ত্রুটি সত্ত্বেও তাহার প্রতি অসীম মমতার ফলে, তিনি বাংলা সাহিত্যে সেই বাঙালী-জীবনের চারণ-কবি হইতে পারিয়াছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী-জীবনের অন্তর্নিহিত যে রূপ, যাহা বাংলার প্রচীনতর শাক্ত ও বৈষ্ণব-সাধনার যুগ্ম-ধারায় সিঞ্চিত, ও রঘুনন্দনের শাসনে দৃঢ়-গঠিত, শরৎচন্দ্র তাহাকেই সাহিত্যে একটি রস-রূপ দান করিয়াছেন। তিনি ইহার দার্শনিক, সমাজতাত্বিক বা ঐতিহাসিক মূল্য বিচার করেন নাই,