পাতা:বিবিধ কথা.djvu/১৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮৬
বিবিধ কথা

করিয়াছিলেন। আজ তিনি সেই লোকালয় পশ্চাতে ফেলিয়া অসীমের প্রান্তরপথে তারাখচিত আকাশের নীচে দাঁড়াইয়াছেন। আজ আর জীবনদেবতা নয়, নিজের ব্যক্তিচেতনার মধ্যে অপরাশক্তির অধিষ্ঠান নয়, অথবা আধ্যাত্মিক উৎকণ্ঠা সমর্পণের জন্য এক পরমপুরুষের আরাধনাও নয়—বিরাট বিশ্বদেবতার লীলাসাক্ষীরূপে কবি এক্ষণে সকল মোহের অতীত হইয়াছেন। সৃষ্টিকে তিনি আজ আর এক চক্ষে দেখিতেছেন। জন্মমৃত্যুর দোলায় বসিয়া তিনি মহাকালের ছন্দ–হিল্লোল হইতেই রাগরাগিণী সৃষ্টি করিতেছেন; তাই মৃত্যু যখন শিয়রে আসিয়া দাঁড়ায়, তখনও কবির কণ্ঠে গান বন্ধ হয় না।

 আমি রবীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভাকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সহিত তুলনা করিয়াছি; দূর আকাশে তুষারপুরীর মধ্যে, তাহার শৃঙ্গরাজি যেমন কখনও আবৃত কখনও প্রকাশিত হইয়া থাকে, ঋতুচক্রের আবর্ত্তন এবং আলো-আঁধারের ইন্দ্রজাল যেমন তাহাকে শতরূপে শতবর্ণে বিলসিত করে, অথচ নভোনীলিমার পটভূমিতে তাহার শুভ্র শেখর অবিকৃত হইয়াই আছে; তেমনই, রবীন্দ্র-প্রতিভার বিচিত্র-বিকাশের মধ্যে একটা মূল প্রকৃতি বা স্থির রূপ নিশ্চয় আছে; কিন্তু কাব্যরসিকের পক্ষে সে রূপ আবিষ্কারের প্রয়োজন নাই; আমরা তাহার বর্ণবৈভব ও রূপ-বৈচিত্র্যের জন্যই সেই গিরিশিখরকে প্রদক্ষিণ করিয়া ধন্য হইয়াছি। আজ আমরা কবির কণ্ঠে যাহা শুনিতেছি, তাহাতে এক দিকে যেমন স্মৃতিস্বপ্নময় অতীত-জীবনের একটি উদাসমধুর রাগিণী ক্ষণে ক্ষণে বাজিয়া উঠিতেছে, তেমনই অনন্তের উদ্দেশে তীর্থযাত্রার নিশ্চিন্ত নির্ভীক পদধ্বনিও তাহাতে শুনিতে পাই—সে গানের পদচারণে ছন্দ ও নিশ্ছন্দের দ্বন্দ্বও লোপ পাইয়াছে। জানি, এ কণ্ঠ একদিন নীরব হইবে, অন্ধকারের