আমার আত্মপ্রীতির বিঘ্ন ঘটিয়াছে। আত্মপ্রীতির জন্য এই যে পরকে আশ্রয় করা—ইহারই নাম হৃদয়-ধর্ম্ম। এই ধর্ম্মের চরম বিকাশে মানুষ শেষে আত্মবিস্মৃত হয়, আত্মরক্ষা শেষে আত্মবিসর্জ্জনে পর্য্যবসিত হয়। এই বিসর্জ্জন বা বিসৃষ্টিও আত্মহত্যা নয়—আপনাকেই ভিতর হইতে বাহিরে প্রক্ষেপ করিয়া, বিষয়ান্তরে আপনাকেই সৃষ্টি করা। এতখানি কল্পনা সকলের নাই, কিন্তু মূলে সকলের ধর্ম্মই এক—সকলেই আত্মধর্ম্মী, আত্মব্রতী। যাহাকে ভালবাসি, স্নেহ করি, সে আমার আত্মীয়, আত্ম-সম্পর্কিত, অর্থাৎ আত্মপ্রীতির আশ্রয়। সেই আত্মীয় যখন মরিয়া যায় তখন যে শোক উপস্থিত হয়, তাহা সাধারণত স্বার্থহানির শোক। কিন্তু তাহাকে আর কোনও প্রয়োজনে পাইব না, এই জীবনের প্রত্যক্ষ লীলামঞ্চে কোনও সুত্রে সে আমার সঙ্গে আর বাঁধা নাই; মৃত্যুর পরে যদি সে থাকে-ও, তবে তাহার জাত্যন্তর ঘটিয়াছে—জীবিত আত্মার সঙ্গে মৃত আত্মার কোনও গুণ-সামান্য নাই, অতএব সে আর আত্মীয় নহে; প্রাণের গভীরতম চেতনায় মানুষ ইহাই অনুভব করে, তাই অজ্ঞানে প্রাণ-ধর্ম্ম পালন করে; কেবল মানসধর্ম্মের তাড়নায় তাহা স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হয়। মানুষ কাঁদে, কিন্তু প্রকৃতি হাসে—জীবধর্ম্ম পালন করিতে সে বাধ্য, করে-ও। এক দিকে শোক করে, আর এক দিকে নিজ জীবনের প্রয়োজন পুরাপুরি সাধন করে।
আত্মীয়-বিয়োগে আত্মার বিয়োগ হয় না; আমাকেই কেন্দ্র করিয়া যে জগৎ দাঁড়াইয়া আছে, আমারই প্রয়োজনে যাহার অস্তিত্ব, আমারই প্রীত্যর্থে যাহাকে আমি চাই—যতক্ষণ আমি বাঁচিয়া আছি ততক্ষণ তাহার ক্ষতিবৃদ্ধির হিসাবে কোনও স্থায়ী তারতম্য হইতে পারে না।