পাতা:বিবিধ কথা.djvu/২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিবিধ কথা

প্রাণ-ধর্ম্মেরই একঠি পরিচয় পরিস্ফুট হইয়া আছে। আমি এক্ষণে তাহারই সম্বন্ধে সবিস্তারে কিছু বলিব। সে যুগের যে তিন শ্রেষ্ঠ পুরুষের কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি, তাঁহাদেরই সাধনায় ও সাধন-মন্ত্রে সেই পরিচয় মিলিবে। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম ও বিবেকানন্দ, ইহারা প্রত্যেকেই প্রাণে যে নূতন ধর্ম্মের প্রত্যাদেশ পাইয়াছিলেন, তাহা, ভারতীয় হিন্দু-সাধনার যে মূল আদর্শ, তাহা হইতে ভিন্ন, কোথাও বা—সেই আদর্শেরই একটা যুগোচিত নূতন প্রবর্ত্তনা। ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ শেষ পর্য্যস্ত আত্ম বা অহংকেই মুখ্য সাধনবস্তু করিয়াছে; তাহাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের চিন্তা, জীবে দয়া, সর্ব্বভূতে সমদৃষ্টির যে তত্ত্বই থাকুক, তাহার মূল লক্ষ্য—ব্যক্তি; সে সাধনা ব্যক্তিকেন্দ্রিক—বহুর উপরে একের প্রতিষ্ঠাই তাহার মূল প্রবৃত্তি। এই অধ্যাত্মবাদ ব্যক্তির স্বতন্ত্র মুক্তিসাধনারই অমুকুল; ইহা একান্তই তত্ত্বপ্রধান ও ভাবতান্ত্রিক—জাগতিক সর্ব্বব্যাপারে অনাসক্তির জন্মদাতা। ইহা মানুষকে—অর্থাৎ পরকে—সর্ব্বজীব বা সর্ব্বভূতের সামিল করিয়া দেখে; মানুষের বাস্তব জীবন-সমস্তা, ব্যথা-বেদনা, কামনা-বাসনা প্রভৃতি দেহদশার নিয়তিকে কোন পৃথক মূল্য দেয় না; মানুষকে মানুষহিসাবেই শ্রদ্ধা কমিয়া তাহাকে ভালবাসার যে মানবধর্ম্ম, তাহা এই ভারতীয় আদর্শে কোন বিশেষ মর্য্যাদা লাভ করে নাই। উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালী জাতির যে নবজাগরণ ঘটিয়াছিল, তাহাতে এই জগৎবিমুখ ব্যক্তিসর্ব্বস্ব আধ্যাত্মিক আদর্শই বিচলিত হইয়াছিল। সেই নব ভাব-বন্যার তিনটি তরঙ্গচূড়া ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিলে বুঝিতে পারা যায়, বাঙালী এই যুগে তাহার জীবনে এক নূতন সত্যের প্রেরণা পাইয়াছিল। সেই ভাব-বন্যার প্রথম বিপুল তরঙ্গ বিদ্যাসাগর; তাঁহার ধর্ম্মে কর্ম্মে, ভাবনা-চিন্তায় আধ্যাত্মিকতার লেশমাত্র ছিল না—