কেবল মানব-সেবার—মামুষের ঐহিক কল্যাণ-সাধনের—এক অতি প্রবল কামনা তাঁহার সারা জীবনে যজ্ঞাগ্নির মত জ্বলিয়াছিল। সেই কামনা এমনই সহজাত ও দ্বিধাহীন যে, ভাবিলে আশ্চর্য্য হইতে হয়, এই ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের সন্তান—যাঁহার চিত্ত হিন্দুশাস্ত্র, সাহিত্য ও দর্শনে আজন্ম লালিত হইয়াছিল, যিনি হিন্দু-সংস্কার ও হিন্দু-আচারের দ্বারা আজীবন পরিবেষ্টিত থাকিতে আপত্তি করেন নাই—তিনিই হিন্দুর শিক্ষা হইতে ষড়দর্শনকে বহিষ্কারযোগ্য বলিয়া স্বমত-প্রকাশে কুণ্ঠ বোধ করেন নাই। তাহার একমাত্র কারণ এই যে, মানুষের বাস্তবজীবন-সমস্যার সঙ্গে এইরূপ বিদ্যার কোন সম্পর্ক নাই; বরং ইহার অতিরিক্ত অনুশীলন মানুষকে অমানুষ করিয়া তোলে। মানুষের পক্ষ হইতে এতবড় বিদ্রোহ-ঘোষণা এ সমাজে তাঁহার পূর্ব্বে আর কেহ করে নাই। এই সঙ্গে তাঁহার কীর্ত্তিরাজি স্মরণ করিলেই বুঝিতে পারা যাইবে, কেন বিদ্যাসাগরকেই সেই নবযুগের পূর্ণ প্রতীক বলিয়া মনে হয়।
এই ধর্ম্মকেই আর এক দিক দিয়া প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিয়াছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি ভাবের ক্ষেত্রকে একটু সঙ্কীর্ণ করিয়া, মানব-সেবার প্রাথমিক ব্রতহিসাবে, একটা জাতি বা গোষ্ঠীচেতনার উদ্বোধন করিয়াছিলেন; এই মানব-প্রেমকেই একটা নির্দ্দিষ্ট দিক্-দেশে, তটশালিনী নদীর রূপে, প্রবাহিত করিবার জন্য সমস্ত প্রাণ-মন ও প্রতিভা নিয়োজিত করিয়াছিলেন। এজন্য, তিনি ব্যক্তির স্বতন্ত্র-জীবনকে বৃহত্তর সংঘজীবনে যুক্ত করিয়া, ঐহিক ও পারমার্থিক উভয়বিধ কল্যাণকে একই সাধনার লক্ষ্য করিয়া ‘বন্দে মাতরম্’-মন্ত্র প্রচার করিলেন; এই মন্ত্রে, ব্যক্তিগত ইষ্টসাধনার যে দেবতা, সেই দুর্গা প্রভৃতির স্থানে, জাতি বা গোষ্ঠীর কল্যাণ-রূপিণী দেবতার প্রতিষ্ঠা করিলেন। এই দেবতার