পরিবর্ত্তে বিশ্বাসের শাসন—এই সকলের সম্মুখে তাহার জাতীয় জীবনের বিকাশপথ কতকটা রুদ্ধ হইয়া আসিল। প্রায় ছয় শত বৎসর ধরিয়া বাঙালী আপনার সমাজ, ধর্ম্ম ও ভাষাকে এই একাস্ত অনাত্মীয় পরধর্ম্মের সংঘাত হইতে বাঁচাইবার চেষ্টায় ব্যাপৃত হইয়া রহিল। এই কালে সে আপনার ধারা ত্যাগ করিয়া প্রাচীন ভারতীয় ভাব, ভাষা ও চিন্তাকে অবলম্বন করিয়া অতিমাত্রায় রক্ষণশীল হইয়া উঠিল; তাহার নিজস্ব স্বপ্ন-কল্পনার ভাবাবেগ—ভারতীয় সাহিত্য, দর্শন ও সমাজনীতির আদর্শে—একটা নূতন আকার ধারণ করিল। ইতিমধ্যে তাহার নিজ ভাষা গড়িয়া উঠিয়াছে, কিন্তু সে ভাষায় প্রবল প্রাণের স্ফূর্ত্তি নাই; পাঁচ শত বৎসরেও এমন একজন কবি জন্মিল না যাহার বাণীতে হিমালয়ের বিরাট গাম্ভীর্য্য অথবা বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গোচ্ছ্বাস প্রতিফলিত হইতে দেখা যায়। এককালে পৃথিবী যাহার গৃহপ্রাঙ্গণ ছিল, গিরিলঙ্ঘন ও সমুদ্রপারাপার যাহার নিত্যকর্ম্ম ছিল, সে এক্ষণে আম্রবনচ্ছায়ে সুপ্ত, গুপ্ত, অথবা লুপ্ত হইয়াই রহিল! তাহার গানে ছন্দের পক্ষবিস্তার নাই, তাহার কাব্যে কল্পনার নিরুদ্দেশ-যাত্রা নাই। কতকগুলি গ্রাম্য-গীতি ও গাথা, এবং গৃহদেবতার মহিমাবর্ণনই তাহার প্রতিভার শেষ নিদর্শন। মনে হয়, এ কোন্ জাতি? মুসলমান-পূর্ব্ব ইতিহাসে, বৌদ্ধ-হিন্দুর নবসমন্বয়ের যুগে, যে জাতির নানা কীর্ত্তির স্পষ্ট ও অস্পষ্ট সংবাদ ঐতিহাসিকের বিস্ময় উৎপাদন করে—সেই জাতি, অবশেষে, এক দিকে তাহার স্বাধীন ভাব-সাধনা গুহ্য তান্ত্রিক অনুষ্ঠানে চরিতার্থ করিতেছে; অপর দিকে আত্ম-বিশ্বাস হারাইয়া, জাতি-ধর্ম্ম বিসর্জ্জন দিয়া, সমাজে, ধর্ম্মে ও চিন্তাপদ্ধতিতে ব্রাহ্মণ্য আদর্শের প্রতিষ্ঠায় উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে! সংস্কৃত ভাষায় তাহার নিজ ভাষার
পাতা:বিবিধ কথা.djvu/২৩০
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাঙালীর অদৃষ্ট
২১৭