ভিত-পত্তন হইল বটে, কিন্তু সে ভিত্তির উপরে সাহিত্যের সৌধ-নির্ম্মাণ হইল না। স্বাভাবিক প্রাণ-স্পন্দনের অভাবে নবসৃষ্টির শক্তি নাই, তাই ভাষা-সাহিত্য অতিশয় গ্রাম্য আশা-আকাঙ্ক্ষার উর্দ্ধে উঠিতে পারিল না। কবিত্ব অপেক্ষা পাণ্ডিত্যের গৌরব হইল; প্রাণের উপরে মনের, এবং কল্পনার উপরের বুদ্ধিবৃত্তির জয়লাভ হইল। তাই এ যুগের কীর্ত্তি হইল—নব্যন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, সমাজ-দেহের অষ্টপৃষ্ঠে স্মৃতিশাস্ত্রের রক্ষাকবচ বন্ধন, এবং সংস্কৃত কাব্য ও অলঙ্কারের অসাধারণ চব্বিত-চর্ব্বণ। ইহাই বাংলাভাষাভাষী অধুনাতন বাঙালী-জাতির মধ্যযুগের ইতিহাস।
৩
পঞ্চদশ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্য প্রভৃতির আবির্ভাবে, সর্ব্ববিভাগে বাঙালীর যে প্রতিভার উন্মেষ হইয়াছিল, তাহাকে বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ দেশপ্রেমিক মনীষী বাঙালীরা নবজন্ম বা রেনেসাঁস বলিয়া গর্ব্ব করিয়াছেন। রেনেসাঁস এক হিসাবে বটে, কিন্তু সেই ব্যাপারের মধ্যে দুইটা বিভিন্ন লক্ষণই আছে। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, মুসলমান প্রভাবের তাড়নায় বাঙালী তাহার সমস্ত শক্তি উদ্বুদ্ধ করিয়া আত্মরক্ষার জন্য আর্য্যসংস্কৃতির শরণাপন্ন হইয়াছিল—বোল্তা যেমন কাঁচপোকার দৃষ্টিপ্রভাবে বর্ণপরিবর্ত্তন করে, বাঙালীর তখন সেই রূপান্তর উপস্থিত। আবার সেই মুসলমান প্রভাবের ফলেই তাহার অন্তর-চেতনা আর এক দিকে সাড়া দিয়াছিল। ব্রাহ্মণ্য আদর্শমূলক সমাজ-ব্যবস্থা তখন সুপ্রতিষ্ঠিত হইলেও, সেই কঠিন ও কৃত্রিম বর্ণ-বিভাগের অন্তরালে তখনও বৌদ্ধসংস্কার একেবারে লুপ্ত হয় নাই; তাই, মুসলমানধর্ম্মের একটি মাত্র উদার নীতি—তাহার অপূর্ব্ব সাম্যবাদ,