যে নূতন আদর্শ একই কালে দুই যুগন্ধর বাঙালীর চিত্তে স্থান পাইয়াছিল, ইহা হইতে আমরা বাঙালী জাতির গভীরতম প্রবৃত্তির পরিচয় পাই। উভয়ের মধ্যেই এই আদর্শ জাগিয়াছিল পাশ্চাত্য প্রভাবের ফলে, উভয়েই ইংরেজী জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রসূত নবভাবের সাধক—উভয়ের মধ্যেই যুগধর্ম্মের পূর্ণ প্রেরণায় সনাতন বাঙালিয়ানা এক নূতন রূপে ফুটিয়া উঠিয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের কল্পনা ও মনীষা ছিল বড়—তিনি ছিলেন নিছক ভাবুক ও কবি; বিবেকানন্দের প্রাণশক্তি বা প্রেম ছিল বড়— তিনি স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করিবার প্রয়াসী ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চাহিয়াছিলেন হিন্দুর শিক্ষাদীক্ষা ও সাধনার ক্রমবিকাশকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুযায়ী একটি সুসঙ্গত ব্যাখ্যার দ্বারা উজ্জ্বল করিয়া তুলিতে; বিবেকানন্দ চাহিয়াছিলেন—হিন্দুসাধনার ইতিহাস যেমনই হউক, তাহার বীজ যে কালেই অঙ্কুরিত হউক এবং ইতিহাসিক জোয়ারভাঁটায় তাহা যত রূপেই বিবর্ত্তিত হউক—তাহার মূল মন্ত্রটিকে জাতির জীবনে ফলবান করিয়া তুলিতে। কোনও তত্ত্ব-জিজ্ঞাসায় নয়, ইতিহাস উদ্ধার করাও নয়, একটা বিশুদ্ধ ধর্ম্মমতের প্রতিষ্ঠাও নয়; তাঁহার প্রধান লক্ষ্য ছিল—জাতিকে, ধর্ম্মবিশ্বাসী নয়, আত্ম-বিশ্বাসী করিয়া তোলা। তিনি জানিতেন, তাহা হইলেই যথেষ্ট, কারণ ‘The soul may be trusted to the end’। এইজন্য রামমোহনের মত সংস্কার-প্রবৃত্তি থাকিলেও, পাছে জাতি নিজের প্রতি শ্রদ্ধা হারায়, এজন্য তাহার সকল অনুষ্ঠানের মধ্যে তাহার প্রাণের আকৃতির দিকটিকে তিনি শ্রদ্ধা করিয়াছিলেন—পূজা-পার্ব্বণ, ব্রত-উপবাস তীর্থযাত্রাদির মধ্যে যেখানে যেটুকু প্রাণের সত্য রহিয়াছে, সেখানে বুদ্ধিভেদ ঘটিতে দেন নাই। তত্ত্বের দ্বারা জীবনকে নিয়ন্ত্রিত না করিয়া, জীবনেরই মধ্য দিয়া সত্যকে
পাতা:বিবিধ কথা.djvu/২৪৩
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৩০
বিবিধ কথা
