পাতা:বিবিধ কথা.djvu/৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০
বিবিধ কথা

 কিন্তু মানুষের প্রাণ এখনও মরে নাই, এবং সম্ভবত কখনও একেবারে মরিবে না, তাই সত্যকে সে আর এক দিক দিয়া উপলব্ধি করিয়া থাকে। এই অসীম বৈচিত্র্য ও বিরোধকে সে প্রাণের দর্পণে প্রতিফলিত করিয়া এক আশ্চর্য্য উপায়ে তাহার মধ্যে একটি ঐক্যরস উপভোগ করে, প্রেমের দ্বারা সে সকল জিজ্ঞাসা ও সকল সংশয় দূর করে; আদি-অন্তের ভাবনা না করিয়া একটি আশ্চর্য্য প্রাণশক্তির বলে সে সুখ-দুঃখ, জয়-পরাজয়, লাভ-ক্ষতিকে যেন একটি গানের সুরে বাঁধিয়া লয়। দর্শন যে প্রশ্ন সমাধান করিতে গিয়া শেষে তাহাকে অস্বীকার করিয়া বসে, বিজ্ঞান যে দুঃখ দূর করিবার আড়ম্বর মাত্র করে—ফলে আরও শতগুণ বৃদ্ধি করিয়া তোলে, সেই দুঃখকে স্বীকার করিয়াই, এই প্রেম তাহাকে নিরস্ত করে। ইহার কারণ কি? প্রেম কোনও সত্যের অধিকারী হইতে চায় না, জগৎ ও জীবনের কোনও অর্থ করিতে চায় না—আপনাকে তাহার নিকটে সমর্পণ করে, বিলাইয়া দেয়। যাহার প্রাণশক্তি যত বেশি, অর্থাৎ যে যত স্বভাবে প্রতিষ্ঠিত, সে এই জগৎ-সমুদ্রে স্নান করিয়া সাঁতার দিয়া ইহার তরঙ্গাঘাত সহ্য করিয়াই তত আনন্দ পায়। যে মানুষের প্রাণে এই আনন্দ আরও ঘনীভূত হইয়া উঠে, তাহার প্রাণে সৃষ্টির বেদনা সঙ্গীতরূপে উৎসারিত হয়, ব্যক্তির সুখ-দুঃখ নির্ব্যক্তিক হইয়া উঠে। এই ব্যক্তির নাম—কবি। ইনি এই আনন্দের সত্যকে রূপ দেন; কিছু বলেন না, কিছু বুঝান না, প্রাণে প্রাণে জানাজানি কানাকানি হয়; যে সত্য জগৎ সৃষ্টিতে প্রচ্ছন্ন রহস্যময় হইয়া রহিয়াছে, মানুষের প্রাণের মধ্যেই সেই রহস্য রসময় হইয়া উঠে। এই রসানুভূতিই সত্যানুভূতি। সত্যের আর কোনও পরিচয় নাই, আর কোনও রূপে তাহাকে জানিবার উপায় নাই।

পৌষ, ১৩৪৫