প্রশ্ন উঠে, তবে দুই উপায়ে তাহার সমাধান হইয়া থাকে—তাহাকে বাংলা বা বাঙালী বলিয়া আলোচনার অযোগ্য হিসাবে বিদায় করা; অথবা, বিদেশী বিদ্যার স্বদেশী প্রয়োগে তাহার এমন অদ্ভুত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা যে, তাহার স্বরূপ-বিরূপ একাকার হইয়া যায়।
এ তো গেল পণ্ডিতদের কথা। সাধারণ শিক্ষিত বাঙালীর ভাব ও ভাবুকতা যাত্রা-থিয়েটারেই চরিতার্থ হয়। সমাজের মধ্যে যাহারা বড়, তাহারা যে দিকে যে কারণে বড় হউক, তাহাদিগকে আমরা ভয় অথবা ভক্তি করি—বিচার বা চিন্তার ধার ধারি না। জ্ঞানের সবচেয়ে বড় যা—সেই আত্মজ্ঞান এ জাতির নাই বলিলেই হয়; হাসিয়া কাঁদিয়া, কখনও মুক্তকচ্ছ, কখনও কৃতাঞ্জলি হইয়া, জীবনটাকে কোনওরূপে সহাইয়া লওয়াই এ জাতের ধর্ম্ম। বিদ্যাসাগর দয়ার সাগর, বঙ্কিম বেড়ে লেখে, এবং বিবেকানন্দ সাহেবদের দেশে হাততালি পাইয়াছে—ইহার বেশি জানিবার বা বুঝিবার প্রয়োজন তাহার নাই, কারণ বৈঠকখানায় বা চণ্ডীমণ্ডপে ঐটুকুই যথেষ্ট। পণ্ডিত ও অপণ্ডিতে তফাৎ এই যে, একজন ধূর্ত্ত, অপরটি বোকা; একজন শহুরে, অপর জন গেঁয়ো।
এই সমাজে যখন বঙ্কিমের মত অতিশয় অসাধারণ প্রতিভাশালী পুরুষের সম্বন্ধে কিছু বলিতে হয়, তখন মনে না হইয়া পারে না যে, সে কথায় কান পাতিবার আগ্রহ কাহারও নাই—আগ্রহ থাকিলেও সে কথার ভাবগ্রহণ করিতে হইলে যে সংস্কার থাকা প্রয়োজন তাহা নাই। কিন্তু কিছু না শুনিয়া এবং না বুঝিয়া, এই সমাজে দাদাঠাকুরের মত পাণ্ডিত্য জাহির করিবার প্রবৃত্তি অনেকেরই হইবে। কারণ, যাহারা থলিতে পরের বুলি বাজাইয়া বাজার সরগরম করে—তাহাদের রসনা নিরঙ্কুশ।