ঘাত-প্রতিঘাতে, অবশেষে তাহার মগ্ন চৈতন্যকে উদ্বুদ্ধ করিয়াছে, তাহাকে আত্মস্থ করিয়াছে। এই প্রভাবের প্রথম ফল রামমোহন; কিন্তু রামমোহনে যাহা একরূপে স্ফুরিত হইয়াছিল, তাহাই অনতিবিলম্বে স্বাভাবিক নিয়মে নানারূপে ফুটিয়া উঠিল। রামমোহনের মধ্যে যাহা মনকে মাত্র স্পর্শ করিয়াছে, তাহাই পরবর্ত্তী কালে জাতির প্রাণে প্রবেশ করিয়া বৃহত্তর ও গভীরতর স্পন্দন সৃষ্টি করিয়াছে; তজ্জন্য রামমোহনই দায়ী নহেন—দায়ী বাঙালীর চরিত্র ও প্রতিভা, এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার ঘনিষ্ঠতর প্রভাব। রামমোহনের প্রভাব যে সীমাবদ্ধ, তাহার প্রমাণ ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাসেই পাওয়া যাইবে। রামমোহনকে এই সমাজ একরূপ জোর করিয়া নিজেদের গুরু বলিয়া প্রচার করেন। রামমোহনের আদর্শ বা অভিপ্রায় ইঁহারা অনুসরণ করেন নাই—কি সমাজ-ব্যবস্থায়, কি ধর্ম্ম-সাধনায়, কুত্রাপি তাঁহারা রামমোহনের উপদেশ গ্রাহ্য করেন নাই। খ্রীষ্টান ধর্ম্মতত্ত্ব ও পাশ্চাত্য দর্শনের মহিমায় আত্মবিক্রীত সেকালের কয়েকজন ইংরেজী-শিক্ষিত ব্যক্তি রামমোহনের উপরে ও তাঁহাদের যুক্তিমূলক স্বাতন্ত্র্যবাদকে স্থাপিত করিয়া যে নূতন সমাজ নির্ম্মাণ করিলেন, রামমোহন জীবিত থাকিলে তাহাতে যোগ দিতেন কি না সন্দেহ। এই তো গেল তথাকথিক রামমোহনপন্থীদের কথা। হিন্দুসমাজ, অর্থাৎ সেকালের বাঙালী জাতি, রামমোহনকে তো গ্রহণ করেনই নাই, বরং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তাঁহার ধর্মতত্ত্ব ও দার্শনিক মতবাদের বিরুদ্ধে একটা প্রবল প্রতিক্রিয়ার দ্বারা এই জাতি আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা করিয়াছিল। বাঙালীর এই সত্যকার জাগরণ-চেষ্টার মূলে যে প্রেরণা কাজ করিয়াছিল, তাহা উপনিষদের নবতন ব্যাখ্যা নয়—জাতির আত্মার ঐতিহাসিক প্রকাশটিকে বুঝিয়া
পাতা:বিবিধ কথা.djvu/৭৪
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
রামমোহন রায়
৬১
