রামমোহনের প্রথম ও প্রধান কৃতিত্ব তিনি এ জাতির ধর্ম্ম সংস্কার করিয়াছিলেন। সংস্কার কথাটির অর্থ যদি এই হয় যে, তিনি হিন্দুর ধর্ম্মমন্ত্রকে বিশুদ্ধ ও উন্নত করিয়াছিলেন, তবে তাহা সত্য নহে। বর্ত্তমান প্রসঙ্গে আমি এ প্রশ্নের বিস্তারিত আলোচনা করিব না, সে অবকাশ নাই। আমি কেবল কয়েকটি প্রধান তত্ত্বের উল্লেখ করিব মাত্র। প্রথমত, পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে যে একেশ্বরবাদ তিনি প্রণয়ন করিয়াছিলেন, তাহার বৈদান্তিক ব্যাখ্যা তাঁহার স্বকপোলকল্পিত; হিন্দুর ধর্ম্মসাধনার ইতিহাসে সেই সেমিটিক ঈশতত্ত্ব কুত্রাপি নাই— উপনিষদেও নাই। ব্রহ্মবাদ একেশ্বরবাদ নহে—অদ্বৈততত্ত্ব Monotheism নহে। শঙ্করের উপরে তিনি যে খোদকারী করিতে চাহিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার তর্কশক্তির পরিচয় আছে; কিন্তু তাহা ‘সোনা ফেলিয়া আঁচলে গেরো দেওয়া’র মত। শঙ্করের অদ্বৈততত্ত্বের উপরে তিনি যে ধরনের ব্রহ্মতত্ত্ব আরোপ করিয়াছেন, তাহা জীববিশেষের স্কন্ধের উপরে অপর জীবের মুণ্ড স্থাপনের মত। এই নব বেদাস্ত-ব্যাখ্যা হিন্দুদর্শন বা ধর্ম্মতত্ত্বের সংস্কার বা সংশোধন নহে; ইহার মূলে ছিল হিন্দুর বিশিষ্ট আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকে নিম্নতর ঈশবাদের দ্বারা আবৃত করিবার চেষ্টা। রামমোহন নিম্নাধিকারীর জন্য যে ধরনের ব্রহ্মজ্ঞান ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহা হিন্দুমতে নিম্নাধিকারও নয়, একেবারে ভিন্ন পন্থা; কারণ তাহা স্বীকার করিলে উচ্চতর অধিকারে আর পৌঁছিতে পারাই যায় না। দ্বিতীয়ত, তিনি পৌত্তলিকতার যে ধারণা করিয়াছিলেন, তাহা সম্পূর্ণ বিজাতীয় মনোভাবের পরিচায়ক। আধুনিক হিন্দুর পূজাপদ্ধতি যদি অনাচার দুষ্ট হইয়া থাকে, তবে তাহার সংশোধন কোনরূপ অহিন্দু ধারণা হইতে করা যাইবে না। যে
পাতা:বিবিধ কথা.djvu/৭৬
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
রামমোহন রায়
৬৩
