“প্রথম সৃষ্টিকর্তা” বাক্যটি কেমন একটু হেঁয়ালির মত শুনিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন, “সেখানে কিছুই প্রস্তুত ছিল না, গদ্য ছিল না, গদ্যবোধশক্তিও ছিল না।” কিন্তু আমরা জানি, রামমোহনের সমকালেই দাঁতভাঙা গদ্যের পাশেই প্রাঞ্জল ও স্বচ্ছন্দ গদ্য ভাষা দেখা দিয়াছে—সে গদ্য রামমোহনী গদ্য অপেক্ষা জীবন্ত ও সরস। কিন্তু রামমোহন ‘বেদান্তসার’ প্রভৃতি দুরূহ গ্রন্থের অনুবাদ করিয়াছিলেন,—তাহার এই অর্থ যে, বাংলা গদ্য রামমোহনের প্রতিভার কবচকুণ্ডলধারী হইয়া ভূমিষ্ঠ হইল। কিন্তু দেখা গেল যে, কবচকুণ্ডলের ভারে সে গদ্য খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া সহজভাবে হাঁটিয়া বেড়াইতে পারিতেছে না। ইহাতে বরং আরও প্রমাণ হয় যে, যে প্রতিভার বলে কোনও লেখক অতি দুর্ব্বল অপরিপুষ্ট ভাষাকেও যেন যাদুবলে সহসা বাল্য হইতে যৌবনে উত্তীর্ণ করিতে পারেন, রামমোহনের পাণ্ডিত্য থাকিলেও সে প্রতিভা ছিল না। সাহিত্যের ইতিহাসে প্রতিভার এমন যাদুশক্তির দৃষ্টান্ত বিরল নহে। আমাদের সাহিত্যেই, গুপ্তকবির পর মাইকেল মধুসূদন দত্তের মহাকাব্য—ভাষা ও ছন্দের অপ্রত্যাশিত সৌষ্ঠবে— প্রতিভার এই যাদুশক্তির নিদর্শন। মধুসূদন দত্তের এই কাব্যখানি খাঁটি বাংলা ভাষা ও বাংলা কাব্যের ধারা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আছে, এমন কথা রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন আগেও বলিতে দ্বিধা বোধ করেন নাই; কিন্তু রামমোহন বাংলা গদ্য-সাহিত্যের স্রষ্টা—ইহা স্বীকার করিতেই হইবে! রামমোহন যে সকল দুরূহ গ্রন্থের অনুবাদ করিয়াছিলেন, তাহা কি বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক হইয়া আছে? তাহা কি কোনও কালে হৃদয়গ্রাহী হইয়াছিল? না, সেগুলি এযাবৎ কাল প্রত্নতাত্ত্বিকের আনন্দবর্দ্ধনের জন্য কোনও রূপে আত্মরক্ষা করিয়া আছে? রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন,
পাতা:বিবিধ কথা.djvu/৮৮
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
রামমোহন রায়
৭৫
