এ যুগের ধর্ম্মান্দোলনের সঙ্গে যে সমস্যা বিশেষ করিয়া জড়িত ছিল, যাহার সমাধান একটা সজ্ঞান সুস্পষ্ট অভিপ্রায়রূপে সেই আন্দোলনে শক্তি সঞ্চার করিয়াছিল, তাহা মুখ্যত মোক্ষলাভ নয়—জাতির জীবনকে নূতন করিয়া একটা নৈতিক ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত করিবার প্রয়োজনচিন্তাই তাহার মূল। সমাজরক্ষা বা লোকসংস্থিতির জন্য যে নীতিমার্গ বা Law—তাহাই ছিল এ যুগের ধর্ম্মসমস্যা। এই ধর্ম্মকে নৃতন করিয়া উদ্ধার করা——তাহাকে যুগোপযোগী রূপ দিয়া জাতির জীবনে প্রতিষ্ঠিত করিয়া যুগ-সঙ্কটে পরিত্রাণলাভের উপায় আবিষ্কার করাই সেকালের বাঙালী মনীষিগণের একমাত্র ভাবনা ছিল। সকলের ধারণা এক ছিল না—আদর্শ পৃথক ছিল। কেশবচন্দ্র এই সমস্যার সমাধানে ভগবদ্ভক্তি ও বিশ্বাসের দ্বারা জাতির নৈতিক উন্নতিসাধনকেই শ্রেষ্ঠ উপায় বলিয়া মনে করিয়াছিলেন, তাঁহার চরিত্রে ও কর্ম্মজীবনে এই অভিনব আদর্শের অনুপ্রেরণা আপাতদৃষ্টিতে বিজাতীয় ভাবাপন্ন বলিয়া মনে হয়; কিন্তু একটু ভিতরে দৃষ্টি করিলে, তাহার মধ্যে বাঙালীর ভাব-প্রকৃতি ও বাঙালী-প্রতিভারই এক নূতন অভিব্যক্তি দেখা যায়। সে যুগের সংস্কার-আন্দোলনের ইতিহাসে কেশবচন্দ্রের এই বাঙালিয়ানাই আমাকে মুগ্ধ করে। পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব বাঙালীর প্রতিভায় কি ভাবে প্রতিফলিত হইয়াছে, তাহা আমরা দেখিয়াছি; পাশ্চাত্য ধর্ম্মনীতি একজন বাঙালীর হৃদয়ে কিরূপ সাড়া জাগায়, কেশবচন্দ্রের প্রতিভায় তাহারও একটি বিশিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। কেশবচন্দ্র যে ধর্ম্ম প্রচার করিয়াছিলেন—যুগের প্রভাব ও জাতির প্রতিভা দুই-ই তাহাতে প্রতিফলিত হইয়াছে। এই দিক দিয়া কেশবকে বুঝিবার প্রয়োজন আছে।
পাতা:বিবিধ কথা.djvu/৯৮
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আচার্য্য কেশবচন্দ্র ও বাংলার নবযুগ
৮৫
